৭ মে ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৩১

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহালচিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের পাতায়

সরদার আবদুর রহমান : দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার চালচিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়। সম্প্রতি নড়াইল সদর হাসপাতালে একজন এমপির অভিযান ও ডাক্তার বরখাস্তের জের ধরে নানান অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই চিত্র উঠে আসে।

গত ২৫ এপ্রিল নড়াইলের সংসদ সদস্য ও ক্রিকেট তারকা মর্তুজা বিন মাশরাফি নড়াইল সদর হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শনে যান। এসময় সেখানে রোগীদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা না পাওয়া ও চিকিৎসক হাজির না থাকার অভিযোগ তোলেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৪ জন ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এই ঘটনায় সারা দেশের চিকিৎসকসমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এনিয়ে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। চিকিৎসকদের সরকারসমর্থিত সংগঠনগুলোর কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে অভিমত প্রদান করলেও এনিয়ে কোন প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ বা কর্মসূচি প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। তবে এই পাল্টাপাল্টি সমালোচনার মধ্য দিয়ে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার অভ্যন্তরের কিছু চিত্র প্রকাশিত হয়।

সামাজিক মাধ্যমে একজন বিশিষ্ট লেখক-চিকিৎসক সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ডাক্তারদের কোন সমস্যা নাই সেটা নয়। তারা ধোয়া তুলসি পাতা নয়। কিন্তু আপনি যেই ব্যবস্থার মধ্যে ডাক্তারদের কাজ করতে বাধ্য করেন সেখানে কাজ করা কোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তিনি উল্লেখ করেন, একটি মানসম্মত স্বাস্ব্য ব্যবস্থা চালাতে হলে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপি’র ৫ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু তা বাংলাদেশে ১ শতাংশেরও কম। শুধু তাই নয়, গত সাত বছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার ২ শতাংশ কমেছে। সরকারি হাসপাতালের ৩৭ ভাগ চিকিৎসকের পদই খালি। সরকার নিয়োগ দেয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৩৩ হাজার ৫৩৮টি। যার বিপরীতে কর্মরত আছেন ২১ হাজার ২২ জন। অর্থাৎ ৩৭ ভাগ চিকিৎসকের পদই খালি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ১০০ জন ডাক্তারের কাজ আপনি ৬৩ জনকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাইলে কোন সেবাটা পাবেন? বাংলাদেশের হাসপাতালে ভারতের মতো সেবা চাইলে সরকারি ডাক্তারের পদ লাগবে কমপক্ষে ৭৫ হাজার। আপনি সেই সেবা ২১ হাজার জনকে দিয়ে দেয়াতে চাইলে হবে?

তাঁর মতে, বাংলাদেশে জনপ্রতি ডাক্তারের সংখ্যা ভয়াবহ- এটা ক্রমাগত কমছে। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জনে ডাক্তারের সংখ্যা ০.২৬ জন, ভারতে বাংলাদেশের চাইতে ডাক্তারের সংখ্যা আড়াই গুণ বেশি, শ্রীলংকায় দ্বিগুণ বেশি আর পাকিস্তানে তিনগুণ বেশি। সারা দেশে এটাই হাসপাতালের স্বাভাবিক চিত্র। তিনি প্রশ্ন রাখেন, যেই হাসপাতালে তার ধারণ ক্ষমতার চাইতে প্রায় আটগুণ রোগীর সেবা দিতে বাধ্য করেন সেই হাসপাতালে আপনি কোন সেবাটা পাবেন? টয়লেট পরিষ্কার রাখতে পারবেন? ওষুধ দিতে পারবেন? বেড দিতে পারবেন? হাসপাতালের ভিতরে যদি আটগুণ রোগীকে জায়গা দিতে হয় তাহলে আউটডোরে সে আটগুণ রোগী সামলাবে কীভাবে? সে তো দুই ঘন্টায় সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলবে।

অপর একজন চিকিৎসক-টিভি ব্যক্তিত্ব ক্রিকেটার-এমপি মাশরাফিকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন তোলেন, আপনি ১১ জনের দলে ৪ জন নিয়ে ক্রিকেট খেলতে রাজি হবেন? তাহলে ২৭ জনের জায়গায় ৭ জন দিয়ে হাসপাতাল চলে কিভাবে সে প্রশ্ন সংসদে করেন! প্রশ্ন করেন ৩০০ বেডের হাসপাতালে ১৮০০ রোগী ভর্তি করলে, ডাক্তার নার্স কেন ছয়গুণ বেশী নিয়োগ দেয়া হয় না? স্টোরে গিয়ে প্রশ্ন নয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন হাসপাতালের স্টোরগুলো কি যথাযথভাবে ঔষধ সংরক্ষণের জন্য মানসম্মত?
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মেরুদ-হীন ডাক্তার সমাজকে ওএসডি করা যতো সোজা, রোগীর জন্য সেবা নিশ্চিত করা ততো সোজা না। আপনার জেলা হাসপাতালে কার্ডিওলজিস্ট আছে, তার জন্য সব যন্ত্রপাতি আছে কিনা প্রশ্ন করেন। বল ছাড়া ক্রিকেট খেলতে পারবেন? তাহলে আধুনিক দুনিয়ায় চিকিৎসার জন্য কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন এবং পেস মেকার বসানোর যন্ত্রপাতি আছে আপনার হাসপাতালে? সেটা জানতে চান। না থাকলে কার্ডিওলজিস্ট থাকা আর তার ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা একই কথা। ওটি’তে যে এ.সি আছে সেটায় হেপাফিল্টার আছে? সেন্ট্রাল মেডিকেল গ্যাস সাপ্লাই?

চিকিৎসক কর্মস্থলে যান না, সেটার জন্য নিয়মানুযায়ী শাস্তি হবে, প্রতিকার হবে। কিন্তু তাকে ধমকানো তো সরকারি বিধান নয়। সবার ডিউটি আট ঘণ্টা। সপ্তাহে ৫ দিন। চিকিৎসক কেন ৬ দিন? কোন সরকারি আইনে এটা করা হচ্ছে? ডাক্তারদের অন্যায় থাকলে সেটার শাস্তি হোক। কিন্তু এলাকার লোককে তো স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। সবখানে অনিয়ম রেখে হাসপাতালকে শুধু স্বর্গোদ্যান বানানো সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, আলোচিত নড়াইল সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের ২৭টি পদের ২০টি পদই শূন্য বলে জানা যায়। মাত্র ৭টি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৭ জন চিকিৎসককে। এই ৭ জনের মধ্যে ১ জন আলোচিত ঘটনায় অভিযুক্ত সার্জারি কনসালটেন্ট। একটা সদর হাসপাতাল অথচ সেখানে হার্ট, মেডিসিন, চক্ষু, নাক-কান-গলা এবং রেডিওলোজির ডাক্তার নেই। সার্জারি কনসালটেন্ট থাকলেও নেই এ্যনেসথেসিয়ার ডাক্তার। প্রশ্ন উঠে, অজ্ঞানের ডাক্তারই যদি না থাকে ওই সার্জন হাসপাতালে ৩০ বছর টানা ২৪ ঘন্টা করে থাকলেই বা লাভটা কি?

চিকিৎসকদের প্রতি প্রশ্ন : অন্যদিকে ফেসবুকে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে পাল্টা কিছু প্রশ্নও ছুঁড়ে দেয়া হয়। যেমন, হাসপাতালে ১৫ জন ডাক্তারের মধ্যে ১৩ জনই অনুপস্থিত কেন, ডাক্তাররা সময়মত কর্মস্থলে উপস্থিত হন না কেন, সরকারি ডিউটির সময়ে বাইরে রোগী দেখেন কেন, রোগীর টেস্ট-এর বিল থেকে ‘কমিশন’ নেন কেন, ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে ‘উপহার’ নিয়ে নিম্নমানের ঔষধ লেখেন কেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঔষধ লেখেন কেন, অপ্রয়োজনীয় সিজার করেন কেন, সিন্ডিকেট করে চিকিৎসা দেন কেন, রোগীর আর্থিক অবস্থানির্ভর চিকিৎসা দেন কেন, একই রোগের সরকারি হাসপাতালে নিম্মমানের চিকিৎসা ও প্রাইভেটে উন্নত চিকিৎসা দেন কেন, আপনাদের লেখা ঔষধের স্লিপগুলো আপনাদের সিলেক্টটেড ফার্মেসি ছাড়া অন্যেরা বোঝে না কেন, সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা নিয়ে কোন আন্দোলন বা বিবৃতি প্রদান করেন না কেন ইত্যাদি। এছাড়াও বিছিন্নভাবে অনেকেই মন্তব্য করেন, একজন রোগীকে প্রথমেই ভিজিট নিয়ে নানা রকম টেস্ট দিয়ে বিদায় করে দেন। পরে তার ব্যবস্থাপত্র পেতে দীর্ঘ হয়রানি পোহাতে হয়। এমনকি কোথাও কোথাও এজন্য পৃথক ভিজিটও দিতে হয়। চিকিৎসকের বাতলে দেয়া নির্ধারিত ডায়গনস্টিক সেন্টারে স্যাম্পল পরীক্ষা না করালে রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করা হয়।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও সংকট নিয়ে চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর কোন কর্মসূচি কিংবা বক্তব্য-বিবৃতি চোখে পড়ে না। অভিযোগ, এসব সংগঠন শক্তিশালী হলেও এগুলো মূলত সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত। স্বপন্থী ডাক্তারদের স্বার্থ, নিয়োগ-পোস্টিং, বিদেশ ভ্রমণ ও বিভিন্ন তদবীরেই সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। ফলে সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি নজর দেয়ার সময় হয় না।

অভিমত : এবিষয়ে অভিমত দেন বিশিষ্ট চিকিৎসক, ডক্টর্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ডা: ওয়াসিম হোসেন। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুযোগগুলো নিয়ে থাকেন সরকারের উপর মহলের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যক্তিরা। তাছাড়া হাসপাতালগুলোতে শিফটিং ডিউটির ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে যিনি রাতে ডিউটি করেছেন তিনি পরের দিন ‘অফ ডে’ পান। এটা সংশ্লিষ্ট মহলের জানা বিষয়। এই সঙ্গে অনেক স্থানে দলীয় লোকেরা অপেক্ষাকৃত ভালো ও সুবিধাজনক জায়গায় পোস্টিং নেন। এতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পদ শূন্য থাকে। অনেকেই উপজেলায় পোস্টিং হলেও জেলা সদরে ডেপুটেশন নিয়ে অবস্থান করেন। ফলে উপজেলায় পদের সংখ্যা ঠিক থাকলেও বাস্তবে উপস্থিত দেখা যায় না। তিনি উল্লেখ করেন, কোর্টে মামলার জট, সরকারি অফিসে ফাইলের স্তুপ- এসব নিয়ে কথা খুব কমই হয়। কিন্তু যেহেতু ডাক্তারদের পেশাটা স্পর্শকাতর, তাই এনিয়ে মানুষের বাড়তি নজর থাকে। এবিষয়টি ডাক্তারদের মাথায় রেখে অন্য পেশার লোকদের চেয়ে বেশি সহনশীলতা প্রদর্শণ করতে হয়। অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে নানা সংকট ও সমস্যার জন্য তিনি প্রধানত সরকারের গাফিলতিকে দায়ী করেন।

দেখা যায়, একটি হাসপাতালে সার্জারি বা গাইনির ডাক্তার পোস্টিং দেয়া হলো। কিন্তু এ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তার পোস্টিং দেয়ার মত লোক পাওয়া গেলো না। সেক্ষেত্রে এই দু’টি পদ অকার্যকর থেকে যায়। হাসপাতালের স্টোরে জরুরি সব ওষুধ মওজুদ থাকেও না। থাকলেও তা দরিদ্র লোকদের পাওয়ার কথা। কিন্তু গরীবের ওষুধ উল্টো নিয়ে যায় প্রভাবশালীরা। অনেক স্থানে যন্ত্রপাতি থাকলেও তা ব্যবহার উপযোগী থাকে না। এগুলো মেরামতের ক্ষমতাও স্থানীয়ভাবে দেয়া হয় না। সবমিলিয়ে এই সংকটের দায় গিয়ে পড়ে ডাক্তারদের উপর। তিনি এসব বিষয়ে সার্বিকভাবে নজর দেয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

http://www.dailysangram.com/post/374624