৭ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ১০:৪২

আজ বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই ওষুধ, করা যায় না এক্স-রে

জনসম্পৃক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যকর নয়। নেই প্রয়োজনীয় জনবল, চিকিৎসক নিয়োগ দিলেও তাদের সবাইকে কর্মস্থলে পাওয়া যায় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ খুবই সীমিত। কোনো কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খুব সাধারণমানের এক্সরেও হয় না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের বেহাল অবস্থা। ইউনিয়ন কেন্দ্রেও ডাক্তার নিয়োগ দেয়া থাকলেও সেখানে তাদের পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এটা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার সংসদে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলে (এসডিজি) স্বাক্ষর করা দেশ তার অঙ্গীকার পূরণ করতে পারবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। এমনই পরিস্থিতিতে বরাবরের মতো আজ বাংলাদেশে পালন হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য।’
নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার মো: মাসুদ উদ্দিন গিয়েছিলেন পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাতভাঙা সমস্যা নিয়ে। তিনি মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে হাত ভেঙেছেন। তাকে দেখে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার প্রথমেই বললেন, বাইরে থেকে একটি এক্সরে করে নিয়ে আসতে। কারণ তাদের এখানে এক্সরে মেশিনটি কাজ করছে না।

পারুলিয়ার হালিমা বেগম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন এক সপ্তাহের জ্বর নিয়ে। হালিমা বেগম জানান, গত এক সপ্তাহ যাবত জ্বর নিয়ে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার তাকে ১০টি প্যারাসিটামল দিয়ে একটি কাগজে সিপ্রোসিন লিখে দিয়ে বললেন, এটা বাইরে থেকে ১৪টা কিনে খেতে। হালিমা জানান, এই ওষুধটি কেনার টাকা তার কাছে নেই কারণ তার স্বামীর কাজ নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে বছরে ৬৭ ডলার (প্রতি ডলার ৮৩ টাকা করে প্রায় পাঁচ হাজার ৫৬১ টাকা) খরচ করে থাকেন স্বাস্থ্য সেবায়। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক ডা: মোজাহেরুল হক একটি জরিপ উদ্ধৃত করে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, জনপ্রতি গড়ে ৬৭ ডলার ব্যয় করার ফলে প্রতি বছর ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলেছে ৬৭ ডলার থেকে স্বাস্থ্য সেবায় খরচ জনপ্রতি ৩২ ডলারে (দুই হাজার ৬৫৬ টাকা) নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি নিজে যে ব্যয় করে তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

তিনি জানান, আমাদের উপজেলায় যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে তা কার্যকর করতে পারলেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রাতারাতি উন্নতি হয়ে যাবে। প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে যে কমিটি রয়েছে তা কার্যকর করতে হবে। উপজেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অথবা সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে যে কমিটি রয়েছে তাকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করার জন্য ক্ষমতা দিতে হবে। তাহলে হাসপাতালের সব ধরনের সমস্যা দূর হয়ে যাবে এবং কার্যকর হবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন, সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান অকার্যকর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে কার্যকর করতে হবে। একটি যুগোপযোগী অর্গানোগ্রাম তৈরি করে এর জনশক্তি বাড়াতে হবে, পরীক্ষার সব ধরনের সুবিধা থাকতে হবে, পূরণ করতে হবে ওষুধের ঘাটতি। বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রয়োজনের ২৫ শতাংশ ওষুধ কিনতে পারে। ওষুধের ঘাটতি পূরণের জন্য তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে কমিউনিটি ক্লিনিকে এমবিবিএস নিয়োগ দিতে না পারলেও প্যারামেডিক নিয়োগ দিতে হবে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া যায় কি না তা দেখার জন্য সরকার টাঙ্গাইলের কালিহাতি, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা চালু করেছে পরীক্ষামূলকভাবে। এই সুবিধা টাঙ্গাইলের আরো আটটি উপজেলায় সম্প্রসারণের জন্য কাজ চলছে। এটা চালু হলে এক সময় টাঙ্গাইলের সব উপজেলায় দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আসবে।

যেভাবে সরকার এগুচ্ছে তাতে করে ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, হেলথ সেক্টরের সমস্যাগুলোর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। শক্তিশালী টাস্কফোর্সের মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে যেখানে এই সেক্টরের অভিজ্ঞরা কাজ করবেন।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রত্যেককে প্রথমেই নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। যদিও কঠিন তবু সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত ও সমবেত উদ্যোগ গ্রহণের উপর তিনি জোর দেন। এ পর্যন্ত পুরাতন স্বাস্থ্য সমস্যাকে আয়ত্বে আনতে পারলেও সামনে চলে আসবে নতুন নতুন স্বাস্থ্য সমস্যা। এসব বিষয়ে জোর প্রদান করা না হলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে না।

খুব অল্প টাকা বিনিয়োগ করে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ঘানা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে পারছে। বাংলাদেশে দক্ষ পেশাজীবীদের চেয়ে অদক্ষরা স্বাস্থ্যসেবায় বেশি কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতেÑ একজন ডাক্তারের অনুপাতে তিন জন নার্স ও পাঁচ টেকনোলজিস্ট থাকা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে তিনজন ডাক্তারের অনুপাতে রয়েছে মাত্র একজন নার্স। নার্স ছাড়া সঠিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মানুষ কাজ করতে পারে বেশি। কমিউনিকেবল রোগ কমে গেলেও আমাদের দেশে বাড়ছে নন কমিউনিকেবল রোগের (এনসিডি) সংখ্যা। কিন্তু সে অনুপাতে নেই ডাক্তার-নার্স। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি, মেডিসিন ও সার্জারির জন্য তিনটি কনসালট্যান্টের পদ রয়েছে। একই সাথে চারজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন ডেন্টিস্ট ও একজন পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের পদ রয়েছে। কোথাও কোথাও রয়েছে ডার্মাটোলজিস্ট, অর্থোপেডিকের পদ। অভিযোগ রয়েছেÑ পদ অনুযায়ী পদায়ন থাকলেও সেখানে প্রয়োজন অনুসারে রোগীরা ডাক্তার পান না।
নরসিংদী সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নরসিংদীর মনোহরদীতে অ্যানেসথেশিয়া, বেলাবতে শিশু ও অ্যানেসথেশিয়া, পলাশে মেডিসিন ও শিবপুরে সার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্টের পদ খালি আছে।

পলাশ উপজেলার দক্ষিণ দেওড়া গ্রামের মো: আরিফ (৫০) তার উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে এসে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো কার্ডিওলজিস্ট পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল ইউনিয়নের নেহাব গ্রামের মো: হজরত আলীর কিডনি সমস্যায় চলে আসেন ঢাকায়। তিনি বলেন, পলাশে অথবা নরসিংদী ডাক্তাররা তার সমস্যাটিই ধরতে পারেননি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/401105