৭ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ১০:৩৮

কর্মসংস্থানহীন জিডিপি কমছে না বেকারত্ব

বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ। সে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা থাকলেও তা না হয়ে উল্টো বাড়ছে বেকারত্ব। কর্মসংস্থানহীন জিডিপিতে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। প্রতি বছর নতুন করে আট লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। কেননা চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না চলতি অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে তুলনামূলক বিচারে বাড়েনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। তাই এই প্রবৃদ্ধি কিভাবে সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ছাড়া শুধু সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে এর সুফল সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তারা। গত ১০ বছরে আর্থ-সামাজিক খাতে অনেক উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন প্রথমবারের মত ৮ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসাব করেছে, তাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। সেই সঙ্গে এবার বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করছে সরকার।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর গত অর্থবছর বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৭৫১ ডলার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তবে গত জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মত সরকার গঠন করার পর থেকেই নতুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলে আসছিলেন, প্রবৃদ্ধির হার এবারই আট শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। এরপর তা ৮ শতাংশের ঘরে পৌঁছাতে সময় লাগলো মাত্র তিন বছর।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার দাঁড়াবে প্রায় ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রাক্কলিত যে হিসাব দিয়েছে, তাতে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরের এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এছাড়া কৃষি খাতে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সেবা খাতে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে এবার, যা গতবার যথাক্রমে ১১ দশমিক ০২ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপি ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বিনিয়োগে আসছে বলে এই হিসাবে ধরা হয়েছে। গত অর্থবছর এই হার ছিল ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ। এবারের বিনিয়োগের মধ্যে সরকারি খাতের অবদান ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, আর বেসরকারি খাত থেকে ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ আসছে বলে তথ্য দেন মন্ত্রী।

সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান সরকারের জন্য রয়েছে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধিসহ পাঁচটি চ্যালেঞ্জ। এগুলো হচ্ছে- কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বেরিয়ে এসে যুব কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, বৈষম্য বৃদ্ধি রোধ করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা ও মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়ে আনা এবং দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন।

এতে আরও বলা হয়েছে, প্রতি বছর ২১ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু প্রতি বছর কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ। এক্ষেত্রে প্রতি বছর ৮ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কাজ পায় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১১ সালে ৬ শতাংশ থাকলেও পরে তা বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশ। সেই সঙ্গে ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। সেটি কমিয়ে এখন ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে দুটি অন্যতম ভাবনার বিষয় হচ্ছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও সে তুলনায় কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। অন্যটি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুফল সর্বত্রই সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। বৈষম্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশের তুলনায় সর্বনিম্ন ৫ শতাংশের আয় বৈষম্য ব্যাপক বেড়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯১-৯২ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনীর আয় ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেটি বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। অন্যদিকে উল্টো চিত্র গরিবদের ক্ষেত্রে। ১৯৯১-৯২ সালে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ গরিবের আয় ছিল ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। সেটি কমে গিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশে। প্রবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে নির্ণায়ক সুচক প্রয়োজন সেখানে অনেক ঘাটতি রয়েছে। প্রবৃদ্ধি যে হিসেবে বলা হচ্ছে তা অন্যান্য সূচকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি যদিও কম মাত্রায় দেখানো হয়েছে,এটিও প্রশ্নবিদ্ধ।

পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের জাতীয় আয়ের যে মূল্যায়ন করা হচ্ছে তা সঠিকভাবে হচ্ছে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় উপাদান বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদদের মতে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগ দরকার জিডিপির অন্তত ৩৫ শতাংশ। সেখানে রয়েছে মাত্র সাড়ে ৩১ শতাংশ।

বিশ^ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ স্থবির, সেখানে তেমন কোনো বড় ধরণের পরিবর্তন নেই। প্রবৃদ্ধির সাথে বিনিয়োগের ধারায় একটি অসঙ্গতি রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং আয় বৈষম্য কমিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজন হবে টেকসই নীতি কাঠামো।

আগে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি থাকলেও এখন এখন আয়হীন কর্মসংস্থান হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও কর্মসংস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন দেশে আয়হীন কর্মসংস্থান হচ্ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে চললেও তা সত্যিকার অর্থে মানুষের আয় বাড়াচ্ছে না। তিনি উল্লেখ করেন, প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়Í এই চারটি সূচকের মধ্যে সামঞ্জস্য না হওয়ায় দেশের যে উন্নতির কথা বলা হচ্ছে তার কোনও সুফল মানুষ পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, সরকারের হিসাব থেকে আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। পাশাপাশি আমরা দেখছি, দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। প্রবৃদ্ধি দিয়ে তো আমাদের কিছু হবে না। প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আমরা তর্ক-বিতর্ক করতে পারি, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, এর ফলাফলটা কী। মানুষের কর্মসংস্থান হলো কিনা, আয় হল কিনা সেটাই বড় বিষয়।

মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যও বেড়েছে বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয়। তার মতে, বাংলাদেশে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। আয় কমেছে উত্তর বাংলায়, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কর্মসংস্থান বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এতদিন আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জন্য তাগাদা দিয়েছি। এই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে শোভন কর্মসংস্থান। কারণ যে কর্মসংস্থানটুকু তৈরি হয়েছে, সেটুকু হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সেখানে আয় কম। ফলাফলটা হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির বিপরীতে আমরা এখন আয়হীন কর্মসংস্থান পাচ্ছি।

http://www.dailysangram.com/post/371262