৭ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ১০:৩১

৬ সন্তানের মাতাকে গণধর্ষণ : বাংলাদেশে বিকৃত ও বীভৎস সংস্কৃতির সংক্রমণ

ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ বাংলাদেশে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতদিন আমরা জানতাম যে মানুষ আদিম লালসা চরিতার্থ করার জন্য ধর্ষণ করতো। যাদের লালসা বিকৃত তারা পাশবিক আনন্দ পাওয়ার জন্য গ্যাং রেপ বা গণধর্ষণ করতো। ধর্ষণ ঘটনা যে অতীতেও ঘটেনি তা নয় কিন্তু সেগুলো তখন কদাচিৎ ঘটতো এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে ঘটতো। কিন্তু গত বছর দুই তিনেক হলো দেখা যাচ্ছে ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ বাংলাদেশে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজের পাতা উল্টালে কোথাও না কোথাও এক বা একাধিক ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। আমার মনে হয় ধর্ষণকে সমাজপতিরা এবং রাষ্ট্র নেতারা সম্ভবত গুরুতর অপরাধ হিসাবে গণ্য করেন না। তাই ধর্ষকরা একের পর এক ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।

ধর্ষণ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর খবরটি পাওয়া গিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ঘটনাটি ঘটেছিল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন ১৯৯৮। মানিক নামে ছাত্রলীগের একজন প্রভাবশালী ক্যাডার একটি পার্টি থ্রো করেছিলেন। উদ্দেশ্য, একটি ঘোষণা দেওয়া। সেই ঘোষণাটি হলো, সেদিন সকালে বিশ^বিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে সে ধর্ষণ করেছে। এই ধর্ষণের মাধ্যমে সে এক শত মেয়েকে ধর্ষণ করলো। এই ধর্ষণের মাধ্যমে তার ধর্ষণের সেঞ্চুরি পূরণ হয়েছে। মানিকের এই ঘোষণার সাথে সাথে ছাত্রদের মাঝে বুনো উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। ঐ পার্টিতে দু’চারজন গর্বিত শিরে বলতে থাকে, কে কতটি ধর্ষণ করেছে।

ধর্ষণের সেঞ্চুরি সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেতা মানিকের এই ঘোষণা পরদিন সংবাদপত্রে ব্যাপক কাভারেজ পায়। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণ জনগণ এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক ক্রোধ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। বিবেকবান মানুষ একে অপরকে প্রশ্ন করতে থাকেন, এ আমরা কোন দেশে বাস করছি? আমরা কি আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে গেলাম? ছাত্র-জনতা তখন ধর্ষণের নায়ক মানিক এবং তার সাঙ্গাৎদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। বিশ^বিদ্যালয়ে মানিকের শাস্তির দাবি যখন তুঙ্গে ওঠে তখন সেই আন্দোলন এবং এ সংক্রান্ত ডামাডোলের ফাঁকে মানিককে জনরোষের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশে ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের পৃষ্ঠপোষকতা।

ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের সেই ট্র্যাডিশন ২১ বছর পর আজও সমানে চলে আসছে। এখন আর ধর্ষণ শুধুমাত্র আদিম লালসা চরিতার্থেরই বিষয় নয়। এখন গণধর্ষণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার। তাই আমরা দেখি, গত বছর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে ধানের শীষের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কারণে ৪ সন্তানের জননী ৩৬ বছর বয়স্কা গৃহবধূকে আওয়ামী লীগের ১২ জন পান্ডা ঘর থেকে বের করে নিকটস্থ মাঠের মধ্যে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এই মহিলাটির বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? মহিলাটির হায়াৎ ছিল, তাই সে বেঁচে যায়।

আজ ৩ মাস হয়ে গেল এই পাশবিক ধর্ষণের নায়ক রুহুল আমিনকে সকলের বিস্ময় উৎপাদন করে আদালত জামিন দিয়েছিল। সাথে সাথে মিডিয়া এবং বিবেকবান মানুষরা এই জামিনের বিরুদ্ধে শোরগোল শুরু করলে উর্ধ্বতন আদালত তার জামিন বাতিল করে। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকেও সমাজের একটি শ্রেণী কত হালকাভাবে গ্রহণ করছে।

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংঘটিত ঐ গণধর্ষণের ঘটনার পর ৩ মাসও অতিক্রান্ত হয়নি। আবার একই জেলার একই গ্রামে অর্থাৎ সুবর্ণচরে এক সপ্তাহ আগে আর একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এবার ভিকটিম হলেন ৪ সন্তান নয়, ৬ সন্তানের জননী এক গৃহবধূ। উপজেলা নির্বাচনে দুই ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। দুইজনই আওয়ামী লীগার। একজনকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নমিনেশন দিয়েছে আর একজন নমিনেশন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে। ঘটনার ভিকটিম এই দুইজন প্রার্থীর একজনকে ভোট দিলে অপর প্রার্থী তার উপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তার ওপর গণধর্ষণ চালায়। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যদি সুবর্ণচরের ৪ সন্তানের জননীর গণধর্ষণের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতো অথবা জনগণ দুরমুজ পার্টি গঠন করে এ্যাকশন নিতেন তাহলে সুবর্ণচরে গণধর্ষণের দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটতো না।

॥ দুই ॥
পরকীয়া প্রেম এবং বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলন আমাদের দেশে এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় অমুকের স্ত্রী ৩ সন্তানের জননী তার সন্তানদেরকে রেখে বিবাহিত অমুক ব্যক্তির সাথে পালিয়ে গেছে। অথবা বিবাহিত ৪৫ বছরের এক ব্যক্তি ৩৩ বছরের এক বিবাহিতা রমণীকে নিয়ে ঐ গ্রাম থেকে ভেগে গেছে। উভয়ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এক মাস বা দু’মাস পর এরা ধরা পড়েছে। তার পর তাদের কি শাস্তি হয়েছে? সে সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে কিছু মালকড়ি খসিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এমন ঘটনা যদি সৌদি আরব এমনকি ব্রুনাইয়েও ঘটতো তাহলে ঐ পলাতক বিবাহিত পুরুষ অথবা ঘর পালানো বিবাহিতা নারীর খবর ছিল। ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ব্রুনাইয়ে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদন্ডসহ সমকামিতা বিরোধী কঠোর ইসলামিক আইন কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল বুধবার থেকে কার্যকর হওয়া নতুন এ আইনগুলোর মধ্যে চুরির দায়ে অঙ্গচ্ছেদের মতো দন্ডও রাখা হয়েছে।

বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র এ রাষ্ট্রটির সুলতান ‘জোরালো’ ইসলামিক শিক্ষা প্রণয়নের কথা বলেছেন। নতুন আইনের উল্লেখ ছাড়াই তিনি বলেছেন, “এই দেশে ইসলামিক শিক্ষা জোরদার হচ্ছে, এটি দেখতে চাই আমি।” নতুন এই আইনানুযায়ী, অভিযুক্তরা যদি নিজেদের সমকামী বলে স্বীকার করে অথবা অন্তত চারজন প্রত্যক্ষদর্শী তাদের এ ধরনের কাজ করতে দেখে তবেই তাদের সমকামিতার দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে। ব্রুনাইয়ে সমকামিতা নিষিদ্ধ এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ডযোগ্য অপরাধ। ব্রুনাইয়ের এই শরিয়া দন্ডবিধির প্রথম অংশটি ২০১৪-র এপ্রিলে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। দন্ডবিধির মুলতবি বিধানগুলোতে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের নামে শিশুসহ যে কাউকে ঢিল ছুঁড়ে হত্যা ও অঙ্গচ্ছেদের শাস্তি দেয়া যাবে।

সৌদি আরবে জেনার (ব্যভিচার) অভিযোগে অপরাধী পুরুষ হোক আর নারী হোক, তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। চুরির শাস্তি সেখানে হাত কেটে ফেলা। এই ধরনের কঠোর শাস্তির বিধান থাকায় সেখানে ব্যভিচার বা চুরির মতো অপরাধ খুব কমই সংঘটিত হয়ে থাকে। সমকামিতা সেখানে আরও বড় অপরাধ। এর শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড। এজন্য সৌদি আরবে সমকামীতার ঘটনা কদাচিৎ শোনা যায়।

এই সব ব্যাপারে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ এবং অনাচার ইসলামী অনুশাসনের দেশে ঘুনে পোকার মতো প্রবেশ করছে। নিউইয়র্কে আমি দেখেছি, সেম সেক্স ম্যারেজের দাবিতে (অর্থাৎ পুরুষে পুরুষে বিবাহের) বিশাল মিছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেছি, এমন বিশাল মিছিল প্রকাশ্যে হতে পারে। শুধু মিছিলই নয়, আমেরিকার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে সেম সেক্স ম্যারেজকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি বিকৃত সেক্সকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অথচ এরাই আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার বড়াই করে।

ভারত বা বাংলাদেশে ঐ ধরনের বিকৃত সেক্সকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দিলেও অন্তত ভারতে লিভ টুগেদারকে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত জায়েজ করে দিয়েছে। লিভ টুগেদার হলো, একটি নারী বা একটি পুরুষ বিয়ে না করেও এক সাথে থাকতে পারে এবং তারা সন্তানও উৎপাদন করতে পারে। আবার তাদের মধ্যে যদি পরবর্তীকালে বনিবনা না হয় তাহলে তারা ছাড়াছাড়িও করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে যে সন্তানটির জন্ম হলো তাকে তাদের সম্পত্তির অংশ দিতে হবে।

॥ তিন ॥
এসব অসামাজিকতা এবং বিকৃতি কেন ঘটছে ? ঘটছে, কারণ ভারতের সংস্কৃতিতে বিশেষ করে অসংখ্য টিভি সিরিয়ালে পরকীয়ার বেপরোয়া ছড়াছড়ি। ভারত একটি বিশাল দেশ। শত শত টিভি চ্যানেল রয়েছে সেখানে। হিন্দি ভাষা ছাড়াও বাংলা, তামিল, তেলেগুসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রয়েছে অসংখ্য টিভি চ্যানেল। আমরা বাংলা এবং হিন্দি কিছুটা বুঝতে পারি। আমরা কলকাতার বাংলা চ্যানেলসমূহ এবং অনেকগুলো হিন্দি চ্যানেল দেখি, যেখানে রয়েছে একটার পর একটা সিরিয়াল। অর্থাৎ ধারাবাহিক নাটক। আমরা অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি যে প্রায় প্রতিটি টিভি সিরিয়ালে রয়েছে পরকীয়ার ঘটনা। সেই পরকীয়া নিয়ে সেখানে ঘটে যায় অনেক কেলেঙ্কারি এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেক ভায়োলেন্স। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে বাংলাদেশের মানুষ টেলিভিশন থেকে বিমুখ হয়ে ভারতীয় বাংলা এবং বেশ কয়েকটি ভারতীয় হিন্দি চ্যানেল টিউন করছেন। সেই সব চ্যানেলের পরকীয়া যদি বাংলাদেশেও সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আমরা বিস্মিত হবো না। বাস্তবে বাংলাদেশেও সম্প্রতি বেশ কিছু পরকীয়ার ঘটনা ঘটছে।

এ সম্পর্কে আর আলোচনা বাড়াবো না। সমাজে নৈতিক ভ্রষ্টাচার, ব্যভিচার, পরকীয়া প্রভৃতি অপরাধ থেকে মুক্ত হতে গেলে নিজেদের মনকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আর সেটি একমাত্র সম্ভব ধর্মীয় মূল্যবোধের জাগরণ ঘটিয়ে। পবিত্র ইসলামের উদার অনুশাসন সেই জাগরণ ঘটাতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি মনযোগের সাথে কোরআন শরীফ এবং হাদীস শরীফ পাঠ করেন তাহলে তিনি দেখবেন, ইসলামে নর-নারীর মধ্যে কি পবিত্র সম্পর্কের বিধান রয়েছে। আরও দেখবেন নারীদের জন্য রয়েছে কত বড় রক্ষাকবচ। আমাদের দেশে মৌলবাদ মৌলবাদ বলে পবিত্র ইসলামকে পরোক্ষে ছোট করা হচ্ছে এবং ইসলাম থেকে তথাকথিত প্রগতিবাদী মহলকে বিমুখ করা হচ্ছে। পরিণতি হচ্ছে ভয়ঙ্কর। সমাজে ভ্রষ্টাচার, পরকীয়া, অবিবাহিত যুবক যুবতীদের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, যেটি ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও তেমন শোনা যেতো না।

এই সমাজকে যদি বাঁচাতে হয়, মানুষে মানুষে যদি সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয় এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হয় তাহলে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে এবং ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।

Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/371260