৬ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ১১:২৪

গুণ বেশি খরচের প্রস্তাব আবার!

সড়ক, সেতু ও রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি অস্বাভাবিক খরচ নিয়ে দেশজুড়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, তখন নতুন সরকার গঠনের মাত্র তিন মাসের মাথায় আলোচনায় আসছে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন একটি প্রকল্পে রেকর্ড ব্যয়ের প্রস্তাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিদ্যমান মিটার গেজ লাইনকে ২৩৯ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ লাইনে রূপান্তরে কিলোমিটারপ্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে খরচ ধরেছে ৫৭ কোটি টাকা! যা সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর তুলনায় সাত গুণ বেশি।

প্রকল্পের প্রতিটি খাতে যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা রেলওয়ের চলমান প্রকল্পগুলোর সঙ্গে তুলনা করে কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাননি পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। রেললাইন নির্মাণে মাটি ফেলা, ব্যালাস্ট, স্লিপার রেল, পরামর্শক ব্যয়সহ সব খাতের খরচ দেখে বিস্মিত তাঁরা। অবশ্য তাঁদের আপত্তির মুখেই আগামী ৯ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদের সর্বশেষ ৪ নভেম্বরের একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হলেও কয়েকজন মন্ত্রীর আপত্তির মুখে

সেটি ফেরত পাঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পে টাকার অঙ্কে কোনো পরিবর্তন না এনে আগের সব খরচ ঠিক রেখে প্রভাবশালীদের চাপে তা আবার একনেক সভায় ওঠাতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।

সারা দেশে বাংলাদেশ রেলওয়ের যতগুলো প্রকল্প চলমান সেগুলোর মধ্য থেকে সমজাতীয় বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আর্থিক খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত বিদ্যমান মিটার গেজকে ডুয়াল গেজে রূপান্তরের পাশাপাশি ডুয়াল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ২৫ কোটি টাকা। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে সাত কোটি টাকা। মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত ব্রড গেজ রেলপথ নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটার গেজ রেললাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়াল গেজ রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ৯ কোটি টাকা। অথচ প্রস্তাবিত আখাউড়া-সিলেট রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৫৭ কোটি টাকা।

তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, প্রতিটি প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য আলাদা। এক প্রকল্পের সঙ্গে আরেক প্রকল্পের কোনো মিল নেই। কোথাও জমির প্রাপ্যতা সমস্যা, কোথাও সেতু নির্মাণের সমস্যা। আবার কোথাও নিচু জমির সমস্যা। সঙ্গে আছে রেলের উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানির খরচও। আখাউড়া-সিলেট রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে পাহাড় ও মাটির প্রাপ্যতার কারণে খরচ বাড়ছে। সে কারণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় তুলনা করা ঠিক হবে না। এতে করে রেললাইন নির্মাণের সঠিক চিত্র উঠে আসে না।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিদ্যমান মিটার গেজ লাইনকে ২৩৯ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ লাইনে রূপান্তর করতে গেলে কাজের ধরন অনেক বেশি হবে। এখানে মাটি, ব্যালাস্ট, স্লিপার রেল, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। সে কারণে অন্য প্রকল্পগুলোর তুলনায় এই প্রকল্পে খরচ বেশি। মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, এই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনার পরই ৫৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।’

প্রকল্পটিতে চীনের একটি কম্পানির অর্থায়নের পাশাপাশি প্রকল্পের ঋণের সুদের হার এবং সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রেলওয়ে এবং পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত প্রতিযোগিতা ছাড়া সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কোনো কম্পানি কাজ পেলে সেখানে কাজের মান খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রকল্পের খরচ বেশি হলো নাকি কম হলো তা বোঝার উপায় থাকে না। এ ছাড়া যে কম্পানি কাজ পাচ্ছে, সে কম্পানি আদৌ এই ধরনের কাজের জন্য কতটা যোগ্য, সেটি নির্ধারণের সুযোগ থাকে না।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, শাহজালাল সার কারখানাসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদাহরণ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এলটিএম বা সীমিত ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা জরুরি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, প্রস্তাবিত আখাউড়া-সিলেট রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে ঋণের সুদের হার হবে ২ শতাংশ। এর পাশাপাশি ম্যানেজমেন্ট ফি ও কমিটমেন্ট ফি আরো ০.৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পে ঋণের সুদের হার ৩ শতাংশে ঠেকবে। অথচ বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো সংস্থার কাছ থেকে এই প্রকল্পে ঋণ নিলে সুদের হার ২ শতাংশের মধ্যেই মিলত।

এই প্রকল্পে ঋণ পেতে অন্য কোনো দেশ ও সংস্থা থেকে ইআরডি প্রস্তাব পাঠায়নি। ফলে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরবিজি) আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজটি পেতে চলেছে। প্রকল্পে টাকার বড় একটি অংশ জোগান দেবে সিআরবিজি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১০ হাজার ২৬৭ কোটি টাকাই আসবে সিআরবিজি থেকে। বাকি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। প্রতিবছর বাজেটে যেভাবে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, তাতে এ ধরনের ঋণ ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাজেটের ওপর আরো চাপ বাড়াবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত প্রস্তাবিত ডুয়াল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে মাটি, ব্যালাস্ট, স্লিপার, রেল, পরামর্শকসহ সব খাতের ব্যয় সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ঈশ্বরদী থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেছেন, এই প্রকল্পে মাটির দর প্রতি ঘনমিটারে নির্ধারণ করা আছে ৩০৫ টাকা। কিন্তু আখাউড়া-সিলেট রেললাইন প্রকল্পে মাটির একক দর নির্ধারণ করা হয়েছে ৮১৩ টাকা। কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব খরচ ধরা হয়েছে, তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি রেলওয়ে থেকে। অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে প্রতি ঘনমিটারে মাটির দর ৩০৮ টাকা থেকে ৩১৬ টাকা। যদিও রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মাটির দরের সঙ্গে রেলের প্রকল্পের মাটির দর তুলনা করা সমীচীন হবে না।

এই প্রকল্পে দেশি ও বিদেশি পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক একজন বিশেষজ্ঞের মাসিক সম্মানী ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা প্রস্তাব করেছে রেলওয়ে। আর স্থানীয় পরামর্শকের মাসিক সম্মানী ধরা হয়েছে চার লাখ টাকা। পরামর্শক খাতের এত বিশাল খরচের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। ঠিক কী কারণে একজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞকে মাসে ২০ লাখ টাকার ওপরে সম্মানী দেওয়া হবে, তার সঠিক জবাবও পায়নি কমিশন। এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, চলমান পদ্মা রেল লিংক সেতু, খুলনা-মোংলা রেল সংযোগ প্রকল্প, লাকসাম-আখাউড়া ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পরামর্শকের এত সম্মানী রাখা হয়নি।

জানা গেছে, প্রকল্পে পরামর্শকদের জন্য ৯টি জিপ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯টি পিকআপ, পাঁচটি মাইক্রোবাস, পিআইইউর জন্য আরো চারটি জিপের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সচিবদের সঙ্গে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় প্রকল্পের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি কেনার বিষয়টি আলোচনা হয়। ওই সভায় কয়েকজন সচিব প্রকল্প পরিচালকদের গাড়িপ্রথা বাতিল করার দাবি তোলেন। কিন্তু এই প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গাড়ির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। প্রকল্পের আওতায় বাড়িভাড়া, নতুন ব্যালাস্টসহ প্রতিটি খাতের খরচ দেখে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন আছে কমিশনের।

রেলওয়ে থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে হবিগঞ্জের মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কমলনগর হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়ে রেললাইনটি শেষ হবে। রেললাইন ডুয়াল গেজের হলে যাত্রীদের নিয়মিত, আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবহন সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/04/06/755480