৬ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ১১:২১

অগ্নিকান্ডে বৈদ্যুতিক ত্রুটি

গত বছর ১৯৬৪২টি ঘটনায় ৩৮৬ কোটি টাকার ক্ষতি

৭৮২৫টি অগ্নিকান্ডের কারণ ছিল বৈদ্যুতিক ত্রæটি

যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে : প্রফেসর ড. এস এম আল মামুন, চেয়ারম্যান,
ইই বিভাগ, ঢাবি

রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের একটি বাসায় গত ১৮ মার্চ এয়ার কন্ডিশনারের (এসি) ক¤েপ্রসার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন স্বামী-স্ত্রী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৫ মার্চ মারা যান উত্তরা পশ্চিম থানার মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস ফারজানা (৪৮)। এর একদিন আগে ২৪ মার্চ দুপুরে তার স্বামী আলমগীর হোসেন ভুঁইয়া (৬২) মারা যান।

নিহত আলমগীরের ভাই তানজিল শাহরিয়ার জানান, রাতে বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন আলমগীর ও তার স্ত্রী। তখন তাদের রুমের পাশে এসি›র ক¤েপ্রসার মেশিন বিস্ফোরণ হয়। এতে জানলার গøাস ভেঙে রুমের ভেতর আগুন ঢুকে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে আগুন পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় তারা দুজন দগ্ধ হন। উত্তরার মতো দেশের সবখানেই এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, দেশে অগ্নিকাÐের সিংহভাগই হয় বৈদ্যুতিক ত্রæটির কারণে। শর্ট সার্কিট, নিম্নমানের ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম ব্যবহার কিংবা বছরের পর বছর তদারক না করায় বৈদ্যুতিক গোলযোগে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর দেশে মোট অগ্নিকান্ডের ৩৯ শতাংশ ছিল বৈদ্যুতিক কারণে।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামের ব্যবহার হলেও সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরিবর্তন করা হয় না। এছাড়া দৈনন্দিন প্রয়োজনে আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবহারও বাড়ছে দ্রæত। নি¤œমানের ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি। এছাড়া ভবন নির্মাণের সময় ব্যবহার করা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ফিটিংস ইত্যাদি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয় না। এতে নড়বড়ে কানেকশন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি তৈরি করছে। শর্ট সার্কিট থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুন নিমিষেই সব পুড়ে ছারখার করে ফেলছে। কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম মোস্তফা আল মামুন বলেন, বাংলাদেশে সংগঠিত অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে অনেক সময় বৈদ্যুতিক তার ও বৈদ্যুতিক যতœাংশ থেকে অগ্নিকাÐেরর ঘটনা ঘটে। ঝড়, বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে বৈদ্যুতিক তার ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ ধরণের দূর্ঘটনার সূত্রপাত হয়।

অনেক সময় দেখা যায়, বাসা বাড়ির ভিতরে বিদ্যুতিক তার বা অন্য কোন যন্ত্রাংশ ইঁদুরে কেটে ফেলার কারণে ওখান থেকে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হচ্ছে। আবার দেশে বিএসটিআই অনুমোদিত নয়- এমন অনেক ধরণের বৈদ্যুতিক যতœাংশের ব্যবহার হচ্ছে। যেগুলো সাধারণত নকলভাবে তৈরী করে সস্তা দামে বিক্রি করা হয়। জনসাধারণও এগুলো চিহ্নিত করতে পারেনা। এক্ষেত্রে এসব যতœপাতি ব্যবহারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা দেশে অগ্নিকান্ড ঘটে মোট ১৯ হাজার ৬৪২টি। এর মধ্যে ৭ হাজার ৮২৫টি অগ্নিকান্ডের কারণ ছিল বৈদ্যুতিক ত্রæটি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ব্যবহারকারীর বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকেই এসব অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে। বৈদ্যুতিক ত্রæটির কারণে সৃষ্ট এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া এসব অগ্নিকান্ডে উদ্ধার করা হয়েছে ১ হাজার ৫৪ কোটি ৪১ লাখ টাকার সমপরিমাণ সম্পদ।

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে অগ্নিকান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ চুলার আগুন। ওই বছর ৩ হাজার ৪৪৯টি বা ১৮ শতাংশ অগ্নিকান্ড ঘটেছিল চুলার আগুন থেকে। এছাড়া ৩ হাজার ১০৮টি বা ১৫ শতাংশ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয় জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা থেকে।

অন্যদিকে গত বছর ছোটদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ৫৮৯টি, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণের কারণে ৩১৫টি, হামলা ও আইনভঙ্গের কারণে ২৫৭টি, মাত্রাতিরিক্ত তাপ সৃষ্টির কারণে ১৬৫টি, মিস ফায়ার ৬৫০টি, চিমনি থেকে ৪৯টি, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় ৩৪টি ও বাজি পোড়ানোয় ৪২টি। যদিও অজ্ঞাত কারণে ১ হাজার ৪১১টি বা ৭ শতাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব আগুনে সর্বমোট ৩৮৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার মালপত্র।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাসাবাড়ি কিংবা বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো থেকে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা নেই ব্যবহারকারীর মধ্যে। ফলে অগ্নিকান্ডের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক কারণই সবার উপরে উঠে এসেছে। এখন থেকে সতর্ক না হলে আগামীতে বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা আরো বাড়বে। তিনি বলেন, আজকাল বাজারে খুবই নি¤œমানের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী পাওয়া যায়। এসব যন্ত্রপাতির বেশিরভাগেরই বিএসটিআই-এর অনুমোদন নেই। অর্থাৎ এগুলো নকলভাবে তৈরী হচ্ছে। বিদ্যুতচালিত নকল এসব সামগ্রী ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো তৈরী বা ব্যবহার বন্ধ না করলে অগ্নিকাÐের ঝুঁকি থেকেই যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে এমন কোনো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নেই যা নকল হয় না। পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডের অলিতে গলিতে তৈরী হচ্ছে নকল টিভি, ফ্রিজ, এনার্জি সেভিং বাল্ব, মোটর, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন মেশিনসহ বিভিন্ন দামী ইলেকট্রিক সামগ্রী। এর আগে র‌্যাবের মোবাইল কোর্ট নর্থ সাউথ রোডের ইলেকট্রনিক্স মার্কেটে অভিযান চালিয়ে দামী ব্র্যান্ডের নকল টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী জব্দ করেছিল। পুরান ঢাকার সুত্রাপুর, মীরহাজিরবাগ, জুরাইন, শ্যামপুর, দনিয়া, ডেমরা এলাকায় রয়েছে শত শত ফ্যান, ক্যাবল, ইলেকট্রিক সুইচ, হোল্ডার, ছকেট কারখানা। কদমতলীর মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডে বিদ্যুতের চোরাই সংযোগে ব্যাকোলাইট মেশিনে কয়েক ধরনের নকল ইলেকট্রিক সামগ্রী তৈরী হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাসের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি বাসাবাড়িতে ইন্টেরিয়র পরিবর্তন কিংবা রঙ করা হয়। কিন্তু বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কোনো পরিবর্তন হয় না। ভবন নির্মাণের সময় যেসব ফিটিংস ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি যুগের পর যুগ ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া এ দেশের বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনও নানাভাবে ত্রæটিপূর্ণ অবস্থায় সড়ক ও ভবনসংলগ্ন এলাকায় রয়েছে। ফলে বৈদ্যুতিক কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছে। যেকোনো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকলেও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার অনুপযোগী না হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয় না। এসব কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে ভবনের অন্য ঝুঁকির সঙ্গে সমন্বয় করে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও পরিবর্তন কিংবা তদারক করা প্রয়োজন।

কর্মকর্তারা বলেন, অধিকাংশ ভবনে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এগুলো অগ্নিঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ভবনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের বসবাস, অতিরিক্ত আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার আগুনের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে। অগ্নিনিরাপত্তায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এসব সমস্যারও সমাধান করতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/197972