৬ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ১১:০৫

রাজধানীতে প্রাণ গেল আরো তিন শিক্ষার্থীর

দেশের অন্য স্থানে সড়কে নিহত আরো ৭

রাজপথে শিক্ষার্থীদের প্রাণ হারানোর ঘটনা যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে। গতকাল রাজধানীতেই দু’টি দুর্ঘটনায় তিন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার মিরপুরে দুইজনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরো সাতজন নিহত হয়েছেন।

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে মারা যায় দুই কিশোর। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় উড়ালসড়ক থেকে নামার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে তারা।

গতকাল বেলা ৩টায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ওই দুই কিশোর হলোÑ তাজউদ্দিন হোসেন তুহিন (১৭) ও আবদুল্লাহ আল নোমান (১৬)। তাদের বাসা রাজধানীর বাসাবোর ওয়াহাব কলোনি এলাকায়।
অন্য দিকে রাজধানীর ডেমরায় বাসচাপায় প্রাণ হারায় ইবনে তাহছিম ইরাম (১৮) নামে এক কলেজছাত্র। এ সময় তার মাথার এক পাশ থেঁতলে গিয়ে মগজ বেরিয়ে যায়। গতকাল দুপুরে ডেমরা-রামপুরা সড়কের মোস্তমাঝির মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ইরাম ডেমরার আমুলিয়া পূর্বপাড়ার মো: দেলোয়ার হোসেনের ছেলে এবং গোলাম মোস্তফা স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

তুহিন ওয়াহাব কলোনির বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে। সে কদমতলী পূর্ব বাসাবো স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীতে পড়ত। আর কদমতলী পূর্ব বাসাবো এলাকার মো: শেখ আহমেদ মজিদের ছেলে নোমান। সে রাজধানীর ইস্টার্ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, মোটরসাইকেলটিতে চালকসহ দু’জন ছিল। তারা মোটরসাইকেল চালিয়ে উড়ালসড়ক দিয়ে খিলগাঁও হয়ে কমলাপুরের দিকে যাচ্ছিল। ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে মোটরসাইকেলটি চলছিল। উড়ালসড়কের ঢাল দিয়ে নামার সময় ছিটকে পড়ে মোটরসাইকেল আরোহী দুই ছেলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। দ্রুতগতিতে চলার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উড়ালসড়কের মাঝখানের বিভাজকের সাথে মোটরসাইকেলটির প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা লাগে। পরে মোটরসাইকেলটি উড়ালসড়ক দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সবুজবাগ থানা-পুলিশ দু’জনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

রাজধানীর ডেমরায় ‘রমজান’ পরিবহনের একটি বাসচাপায় প্রাণ হারায় ইবনে তাহছিম ইরাম (১৮) নামে স্থানীয় এক কলেজছাত্র। স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে নিহত ইরামের লাশ তার পরিবারের লোকজন উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায়।

দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় রামপুরা থেকে ট্রাফিক পুলিশ রমজান পরিবহনের ওই বাসটিসহ (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৩৬৮৭) চালক মো: শামীম ও হেলপার মুন্না মিয়াকে আটক করেছে।
তবে এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও কলেজ শিক্ষার্থীরা ডেমরার আমুলিয়া, স্টাফ কোয়ার্টার ও সুলতানা কামাল সেতু এলাকায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর, বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে রাখে।
এতে ডেমরা-রামপুরা ও ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গ্যারেজে গিয়েও বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করে। এ সময় ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইরাম দুপুরে খেলা শেষে সাইকেলে মোস্তমাঝির মোড় হয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ছেড়ে আসা রামপুরাগামী রমজান পরিবহনের ওই বাসটি ইরামকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে রামপুরায় গিয়ে বাসটিসহ হেলপার ও চালক আটক হয়।
রামপুরা ট্রাফিক জোনের টিআই বিপ্লব ভৌমিক জানান, কলেজছাত্র ইরামের নিহতের খবর পেয়ে রামপুরা জোনের ট্রাফিক পুলিশ বাসসহ চালক ও হেলপারকে আটক করে। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচার করবে প্রশাসন।

সরেজমিন দেখা গেছে, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী রামপুরা সড়কের আমুলিয়ায় গাছের গুঁড়ি ও ঢালাই পাইপ ফেলে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। স্থানীয় সাংবাদিকদেরও ছবি তুলতে দিচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন হাতে নিলেই তারা উত্তেজিত হয়ে উঠছে।

মীরপাড়া এলাকায় গ্যারেজে রাখা অন্তত ৩৫টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে শিক্ষার্থীরা। তা ছাড়া এলাকার অন্য সব গ্যারেজে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস ভাঙচুর করে। বিক্ষোভের সময় উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা জানান, ডেমরার যাত্রীবাহী বাসগুলোর চালক ও হেলপাররা সব অদক্ষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক। তার নেশাগ্রস্ত হয়ে সড়কে অনেক বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালালেও পুলিশ কিছু বলে না।

ডেমরা থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশদের মাসোহারা দিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্করা গাড়ি চালায় বলে ডেমরার সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা হচ্ছেই। প্রশাসন সঠিক ব্যবস্থা নিলে এমন হতো না। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা দুই দিনের বিক্ষোভ ঘোষণা করে স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় সব গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়।
ডেমরা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মো: রবিউল ইসলাম বলেন, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রথমে ভাঙচুর করলেও পুলিশের উপস্থিতির পর তারা রাস্তায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছে। নিহতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে। তা ছাড়া চালক ও হেলপার আটক রয়েছে।
গড়ে প্রাণ যাচ্ছে প্রায় ১৪ জনের

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত তিন মাসে দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৪৯টি। এতে নিহত হয়েছে এক হাজার ১৬৩ জন। আহত হন এক হাজার ৯৯৮ জন। জানুয়ারিতে নিহত হন ৩৩৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪২১ জন এবং মার্চে নিহত হন ৪০৩ জন। গতকাল এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান গতকাল বলেন, এই সড়ক দুর্ঘটনার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। যে কারণে এবারের বাজেটে তারা বরাদ্দ দাবি করবেন। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য এই বরাদ্দ দেয়া হবে।

বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন মাসে এক হাজার ১৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ২১২ জন নিহত ও দুই হাজার ৪২৯ জন আহত হয়েছেন।

মিরপুর (কুষ্টিয়া) সংবাদদাতা জানান, কুষ্টিয়ার মিরপুরে ট্রাকের ধাক্কায় পাখিভ্যানের চালকসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে কুষ্টিয়া- মেহেরপুর সড়কের ভাঙ্গা বটতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেনÑ মিরপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের দুল্লা মল্লিকের ছেলে কাইসলাম (৪৫) এবং একই উপজেলার খন্দকবাড়িয়া গ্রামের লাল মোহাম্মদের ছেলে মুন্নাফ (৫০)। স্থানীয়রা জানান, আলমডাঙ্গা থেকে মাছ শিকার করে নিজস্ব ভ্যানে মিরপুর ফিরছিলেন দুই বন্ধু কারিবুল ও মুন্নাফ। কুষ্টিয়া-মেহেরপুর সড়কের ভাঙ্গা বটতলায় বিপরীত দিক থেকে দ্রুত আসা একটি মালবোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভ্যানকে ধাক্কা দেয়। এতে ভ্যানচালক মুন্নাফ ও কারিবুল রাস্তায় ছিটকে পড়েন এবং ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। মিরপুর থানার ওসি আবুল কালাম জানান, ঘাতক ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে।

শিবালয় ও ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাকচালকসহ দুইজন নিহত এবং বাসের ১৫ যাত্রী আহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে শিবালয় উপজেলার মুশুড়িয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত যাত্রীদের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শিবালয়ের হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়ামিন উদ-দৌলা সাংবাদিকদের জানান, ঢাকা থেকে রাজবাড়ীর উদ্দেশে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী রাবেয়া পরিবহনের একটি বাসের বিপরীতমুখী একটি ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ট্রাকচালক প্রাণ হারান। বাসের আহত যাত্রীদের মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে আরো একজনের মৃত্যু হয়।

চান্দিনা (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার চান্দিনায় মিনি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় আবদুল আলিম (২৮) নামের এক ভ্যানচালক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো দুই পথচারীসহ আহত হন তিনজন।
গতকাল সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাধাইয়া বাজারসংলগ্ন ব্রিজের ওপরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আবদুল আলিম কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ভানী গ্রামের আবুল হাসেম মিয়ার ছেলে। আহতরা হলেনÑ চান্দিনা উপজেলা সোনাপুর গ্রামের আবুল কালামের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার ও দেবীদ্বার উপজেলার আবদুল কাদেরের ছেলে মো: আবু হানিফ এবং বরিশালের নাজিরপুর থানার ইন্দ্রেরহাট গ্রামের মৃত জামাল খানের ছেলে মিনি কাভার্ডভ্যানের চালক মো: শাহিন।

মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাটে অজ্ঞাত গাড়ির চাপায় আনোয়ারা বেগম (৮০) নামে এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। গতকাল সকালে বারইয়ারহাট পৌরসদর এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। আনোয়ারা মিরসরাই উপজেলার ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী এলাকার ফখরুল ইসলামের স্ত্রী।

খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর খানজাহান আলী থানার শিরোমনি বাইপাস সড়কে এক দুর্ঘটনায় রজব আলী রাজু (৫৪) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/400889