৬ এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ১০:৪৭

সবকিছুতে রাজনীতি টেনে আনা অনুচিত

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, একটু কিছু হলেই রাজনীতি টেনে আনি। কিন্তু এটা যে একটা বদ অভ্যাস তা ভাবি না বা মনে করি না। এতে অনেক সময়েই হিতে বিপরীত হয়। লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়। অর্থাৎ ফল হয় উল্টো। একথা আমরা অনেকে বুঝতেই চাই না। বুঝলেও তা অনেক পরে বুঝি। তখন সময় অনেক গড়িয়ে যায়। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়।

বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত গাড়ির পানির পাইপে লিকেজ দিয়ে গলগলিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ে রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। মিডিয়ার ক্যামেরা ম্যানসহ এন্ড্রয়েড মোবাইলেও অনেকে ছবি তুলছিলেন।

সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখার গর্জনের মাঝেও ক্যামেরার খচাখচ শব্দ যেমন শোনা যাচ্ছিল, তেমনই ফ্লাসলাইটও জ্বলে উঠছিল বারবার।

আগুন নেভানোর গাড়ির পাইপের ছিদ্র দিয়ে পানি বেরোনো দেখে একটি ছোটছেলে খালি হাতে তা আটকাবার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে পানি নষ্ট না হয় এবং পানির ফোর্স বাড়ে। কিন্তু কিছুতেই পানি থামানো যাচ্ছে না। কে যেন একজন দৌড়ে কোথা থেকে একটা বড় পলিথিন এনে দেয় ছেলেটিকে। ব্যস! সেটা দিয়েই পাইপের ফুটো চেপে ধরতে সক্ষম হয় ছেলেটি। আর তরতর করে পাইপের পানির গতি বাড়ে এবং উঠে যায় অনেক ওপরে।

শিশু নাঈম বনানী অগ্নিকা-ে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের পানির ফাটা পাইপ চেপে ধরে একটা ভালো কাজই করেছে। সবাই ওর বুদ্ধির প্রশংসা করেছেন। ছবিসহ নাঈমের খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাল হয়। নাঈমের বুদ্ধিদীপ্ত কাজে খুশি হয়ে একজন প্রবাসী তাকে ৫ হাজার ডলার দান করবেন বলে জানান। যাতে ছেলেটি প্রয়োজনীয় খরচ ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটা অনেকেরই সহ্য হলো না। বিষয়টি নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি শুরু হয়ে গেল।
নাঈমকে দিয়ে বলানো হলো: 'খালেদা জিয়া এতিমদের টাকা মেরে খেয়েছেন। আর তাই এ টাকা আমি এতিমখানায় দিয়ে দেবো।'

এখনও প্রবাসী ভদ্রলোক টাকাটা পাঠাননি। ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র।

নাঈমের মুখে অন্যের শেখানো বুলি শোনার পর প্রবাসী ভদ্রলোক সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি আর এক টাকাও দেবেন না। ঠিকই করেছেন প্রবাসী ভদ্রলোকটি। তাঁর এ মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি হলে কেন দেবেন টাকা ? উল্লেখ্য, শিখিয়ে দেয়া কথা বলবার জন্য শাহরিয়ার নাজিম জয় নাঈমের মাকে খামের ভেতর দুই হাজার টাকা দেন বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে।

সর্বশেষ আপডেট হলো: নতুন সাক্ষাৎকারে শিশু নাঈম এবং তার মা নাজমা বেগম দুইজনই জানিয়েছে, আগের কথা তারা না বুঝে বলেছে। অন্যের শিখিয়ে দেয়া কথা বলে ভুল করেছে। ওরা নিজেরাই গরীব। তাই টাকা এতিমখানায় না দিয়ে তারাই নেবে। কিন্তু প্রবাসী ভদ্রলোক নাঈম ও তার মায়ের কথায় আবার টাকা দিতে রাজি হলেতো?

অভিযোগ উঠেছে নাঈমের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী অভিনেতা ও উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয়ের বিরুদ্ধে। তিনি নাঈমকে টাকা এতিমখানায় দানপ্রসঙ্গ এবং বেগম জিয়ার এতিমের টাকা মেরে দেবার কথা শিখিয়ে দেন। কিন্তু শাহরিয়ার জয় অভিযোগ অস্বীকার করে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, নাঈম নিজেই ওই কথা বলেছিল। তিনি মোটেও তা ওকে শেখাননি। বরং তিনি নিজেও নাঈমের ওমন কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন।

শাহরিয়ার নাজিম জয় উল্লেখ করেন, নাঈমের সাক্ষাৎকার প্রচারের পর তাঁকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। প্রাণনাশেরও হুমকি পেয়েছেন তিনি। শাহরিয়ার জয় শঙ্কিত। বিব্রত। তিনি মহামান্য প্রেসিডেন্ট ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন এক ভিডিও বার্তায়।

আমার মনে হয় নাঈম যেভাবে এতিমের টাকা মারবার প্রসঙ্গটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়েছে তা অভাবনীয় এবং অবশ্যই কারুর পরিকল্পিতভাবে শেখানো। ওর সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগে শাহরিয়ার জয় না শেখালেও কেউ না কেউ শিখিয়েছে। কিন্তু তিনি তা সম্প্রচার করলেন কীভাবে? তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইলেও তা কি আসলেই সম্ভব? তবে যাই হোক, যা সর্বনাশ হবার হয়েই গেছে।

অবস্থাবানদের কাছে ৫ হাজার মার্কিন ডলার তেমন কোনও অর্থ নয়। মাত্র ৪ লাখ ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। খুব বেশি কিছু নয়। তবে নাঈম ও তার মায়ের কাছে এটা বড় অঙ্কের টাকাই। যে মা বস্তিতে থাকেন, পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন এবং স্বামী পরিত্যক্তা, সেই মা এবং নাঈমের কাছে ওই টাকা আসলেই অনেক। ওটা পেলে বাবা সংসারে না থাকবার ফলে যে সমস্যা হয় সেটা হয়তো অনেকখানি কমে যেতে পারতো। কিন্তু সর্বনেশে সাক্ষাৎকার সেটা আর হতে দিল না। জানিনা, শাহরিয়ার নাজিম জয় নাঈম ও তার মায়ের যে ক্ষতিটা করলেন সেটা কীভাবে পূরণ করবেন?

টেলিভিশন, ফেসবুক যথেষ্ট সেনসেটিভ বা স্পর্শকাতর মাধ্যম। এগুলোতে কিছু বললে বা সম্প্রচার করলে তা রয়েসয়ে এবং ভেবেচিন্তে বলা দরকার। সম্প্রচার করতে হয় চিন্তাভাবনা করে। হুটহাট করে কিছু করা একদম অনুচিত। নাঈমের আত্মঘাতী কথা সম্প্রচার না করলে এই সর্বনাশ তার নিশ্চয়ই হতো না। অতি উৎসাহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী হয়। নাঈমের ক্ষেত্রেও তাই হলো বলে আমার মনে হচ্ছে।

নাঈম ছোটমানুষ। শিশু। পড়ে আনন্দ স্কুলে ক্লাস ফাইভে। থাকে কুড়িল বস্তির বউবাজার এলাকায়। ওতোকিছু সে জানে না। বোঝেও না। সেদিন আগুন নেভানোর পানি নষ্ট হচ্ছিল বলে বুদ্ধি করে পাইপের ছিদ্র চেপে ধরেছিল। এতেই তার ছবিটা ভাইরাল হয়। ফেসবুকে ছড়ায়। কাগজে ছাপা হয়। টিভিতেও দেখা যায়। সে অবশ্য এতো কিছু দেখেনি। জানেও না। তবে লোকের মুখে শুনেছে আর মুচকি হেসেছে। কে টাকা দিতে চেয়েছেন? কোথাকার লোক তিনি? তাও জানা নেই নাঈমের।

নাঈমকে ভাইরাল করেছেন পাপারাজি বা ক্যামেরামেন ও সেলফিবাজরা। এর ফলেই নাঈমের প্রতি সদয় হন আমেরিকাপ্রবাসী ভদ্রলোক। কিন্তু তার সুফল ভোগ করতে দিল না নাঈমের একটি কথা। যেটা ওকে শিখিয়েছিলেন একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। সেটি সম্প্রচার হয়েছিল কোনও টিভি চ্যানেলে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর ওটাই হয়েছে নাঈমের জন্য কাল।

সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যাই বলি না কেন, এসবের দ্বারা কারুর উপকার করতে না পারলে করবেন না। কিন্তু নিরপরাধ নিরীহ মানুষের যাতে কোনওরূপ ক্ষতি না হয় এটা খেয়াল রাখা জরুরি। এমনিতেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এরপর দরিদ্র শিশু নাঈমের যে ক্ষতিটা করলো মিডিয়া তা কি কোনওভাবে পূরণ করা সম্ভব? নিশ্চয়ই না।

নাঈমের বুদ্ধিদীপ্ত কাজের জন্য পুরস্কারস্বরূপ একজন প্রবাসীর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান ঘোষণার সঙ্গে রাজনৈতিক ‘বিষ’ মিশিয়ে তা মাটি করে দেয়া হলো। আর এজন্য দায়ী একশ্রেণির তৈলমর্দনকারী মিডিয়া এবং তাদের সংবাদকর্মীরা। তাই বলছিলাম, সবকিছুতে রাজনীতি টেনে আনা ঠিক নয়। আর রাজনীতি এখন মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে না প্রায়শ। দলবাজি আর তেলবাজি না জানলে রাজনীতিতে ফায়দা তেমন নেই বললেই চলে। এটা দেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। এত্থেকে সংশ্লিষ্টদের বেরিয়ে আসা খুব জরুরি।

সর্বশেষ খবর হচ্ছে: নাঈম ও তার মা না বুঝে অন্যের শেখানো যে কথা বলেছিল সেটা ছিল ভুল। এটা নাঈমের মা নাজমা বেগমের সঙ্গে সরাসরি মোবাইলে কথা বলে ওই প্রবাসী শিশু নাঈমকে টাকাটা আবার পর্যায়ক্রমে দিতে চেয়েছেন। একথা তিনি এক ভিডিও বার্তায় জানান। তাই আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

http://www.dailysangram.com/post/371122