ড. মোজাফফর হোসেনের দুঃসহ জীবন; ইনসেটে মোজাফফর
৫ এপ্রিল ২০১৯, শুক্রবার, ৭:২৪

জীবনের নির্মম পরিণতি!

মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ পেরুলেই নির্জন কান্দা পৌলি গ্রাম। এ গ্রামের অহঙ্কার ছিলেন বিজ্ঞানী ড. মোজাফফর হোসেন। বাড়ি গিয়ে দেখা গেল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। একটি ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। জিজ্ঞেস করা হলো কেমন আছেন? কোনো উত্তর নেই। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন। এরপর নিজেই শুরু করলেন এলোমেলো গান আর কবিতা। তার দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন রোকেয়া বেগম নামে এক কাজের মহিলা। প্রতি মাসে ঢাকা থেকে কিছু টাকা পাঠান ড. মোজাফফর হোসেনের স্ত্রী লিপি। অসুস্থতার জন্য কোনো ওষুধ সেবন করানো হয় না। শুধু ২৫ পাওয়ারের একটি করে ট্রিপটিন খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। গায়ে ভালো কোনো পোশাক নেই, দু’বেলা খাবারও ঠিকমতো জোটে না।

মূল্যবান জীবনের কী নির্মম পরিণতি! সুখে-শান্তিতে থাকার জন্য একজন মানুষ কত কিছুই না করে। আর সুখে থাকার জন্যই সোনার হরিণ সরকারি চাকরির খোঁজে অস্থির হয়ে যান শিক্ষিতরা। এই বিসিএস ক্যাডার বিজ্ঞানী ড. মোজাফফর হোসেনের কী অবস্থা দেখুন! একটা শূন্য বাড়িতে দড়িতে বাঁধা তার জীবন। অথচ স্ত্রী-সন্তান, সহায়-সম্পদ কোনো কিছুরই অভাব নেই তার। কিন্তু এখন আর সেসব কোনো কাজেই আসছে না তার। মানসিক ভারসাম্য হারানোর কারণে তার আজ এ অবস্থা।

ঢাকা শহরে যার থাকার কথা ছিল বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখে আনন্দে কাটানোর কথা ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কিন্তু আজ তিনি বড়ই অভাগা। চিকিৎসাসেবা তো দূরের কথা দুবেলা খাবারও জোটে না ঠিকমতো। স্ত্রী-সন্তানরাও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঢাকা শহরের রঙিন দুনিয়া থেকে বোঝা মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার কান্দা পৌলির নির্জন গ্রামে। একটি ঘরের মেঝেতেই চলছে তার থাকা-খাওয়া সব কিছু। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কখনো গান, কখনো কবিতা আর কখনো উচ্চস্বরে হাসেন এবং কাঁদেন।

একজন কাজের মহিলা আর গ্রামের প্রতিবেশীরাই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। মানুষটি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন দেশের অহঙ্কার বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার বিজ্ঞানী ড. মোজাফফর হোসেন। দায়িত্বে থাকা রোকেয়া বেগম নিজে খেয়ে না খেয়ে তার মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন। কথা হয় রোকেয়া বেগমের সাথে। ড. মোজাফফর হোসেনের সেবা করতে করতে তিনিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। জানালেন, তিন মাস ধরেই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মতো তার সেবা করতে হচ্ছে। পায়খানা-প্রস্রাবের সবই এক হাতেই করতে হয়।

মানুষটির স্ত্রী-সন্তানরা যে এত পাষাণ হবে তা ভাবতে কষ্ট হয়। ঢাকা থেকে যেদিন তাকে গ্রামে দিয়ে গেল- মানুষটির দিকে তাকানো যেতো না। মনে হয় পেটে-পিঠে লেগে গেছে। মুখখানি কালো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারা যে কয় টাকা দেয় তা দিয়ে একজন রোগীর খাওয়া-দাওয়া ও সেবা-যতœ করা কঠিন। সব সময়ই খেতে চায়। ওই টাকার মধ্যে আমি যতটুকু পারি তা দিয়েই খাবার জোগাড় করি। মানসিক ভারসাম্য হারালেও মৃত মা-বাবার কথা মনে করে প্রায় রাতেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। থামানো যায় না। পাড়াপ্রতিবেশীরা সব সময়ই সহযোগিতা করেন। তা না হলে মানুষটিকে লালন পালন করা যেত না। মানুষটির ভালো চিকিৎসা হলে ভালো হয়ে যেতো। খুব কষ্ট লাগে তার জন্য। তাই নিজের বাবার মতোই দেখার চেষ্টা করি।

ড. মোজাফফরের বাল্যবন্ধু ডাক্তার সাঈদ আল মামুন জানান, সম্ভবত মোজাফফর অ্যালজেইমার রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্তদের স্মরণশক্তি কমে যায়। অতীত-বর্তমানের কথা ভুলে যায়। কাউকে চিনতে পারে না। অনেক সময় উচ্চস্বরে চিৎকার করে। কিন্তু এভাবে বিনা চিকিৎসায় তাকে নিঃসঙ্গভাবে ফেলে রাখা হলে অবস্থা আরো বেশি খারাপের দিকে যাবে। তাই তাকে পরিবারের সদস্যদের সময় দেয়া উচিত। পাশাপাশি তাকে ভালো নিউরোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।
তবে ড. মোজাফফরের স্ত্রী লিপির সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি ভিন্ন কথা বলেন। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, মোজাফফর জটিল রোগে আক্রান্ত। ঢাকায় থাকাকালীন আশপাশের প্রতিবেশীরা প্রতিদিনই তার পাগলামির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিত। সে কারণে তাকে গ্রামের বাড়ি রাখা হয়েছে। স্বামীর সেবা-যতেœর জন্য গ্রামের এক নারীকে বেতন দেয়া হয়। চিকিৎসাসেবাও দিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, তার স্বামী কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। সব সময়ই পাগলের মতো আচরণ করেন। ওষুধ কি খাওয়াচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, মনে হয় ওষুধ শেষ হয়ে গেছে, আমি ঢাকা থেকে দিয়ে আসব। তিনি জানান, দুই ছেলে লেখাপড়া করছে। তাই সন্তানদের সাথে আমি ঢাকায় থাকছি।

জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন বিজ্ঞানী ড. মোজাফফর হোসেন। পিএইচডি করেন রসায়নের ওপর। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার থাকাকালীন তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ২০১৪ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর মানসিকভাবে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় এককালীন অর্ধ কোটি টাকা পেলেও সবই স্ত্রীর জিম্মায় চলে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু দিন চিকিৎসা করানো হলেও সুফল পাননি। বড় ছেলে অর্ণব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট ছেলে আরিয়ান এইচএসসিতে লেখাপড়া করছে। মায়ের সাথে দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। আর গ্রামে অযতœ-অবহেলা এবং বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন ড. মোজাফফর হোসেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/400664