৫ এপ্রিল ২০১৯, শুক্রবার, ৭:০৩

ভোটার খরায় উপজেলা নির্বাচন

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : পৃথিবীর যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ সর্বাধিক নির্বাচনমুখী। কারণ এ দেশের মানুষ ভোটের অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম ও জীবন বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সে ভোট আজ উধাও। যে কারণে উৎসবের ভোট নিরুত্তাপ ভোটে পরিণত হয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে জাতির প্রত্যাশা ছিল দলীয় সরকারের অধীনে হয়ত এবার একটি সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু হলো না। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর দেখা গেল সবই গুড়ে বালি। ভোটারবিহীন নির্বাচনের নামে তামাশা জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, উপজেলা নির্বাচন ও ডাকসু নির্বাচনে জাতি দেখেছে। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। তাহলে কেন বারবার নির্বাচনী আমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষের রুগ্নতা সরানো যায়। কিন্তু ক্ষমতার রুগ্নতা দূর করা বেশ কঠিন। কারণ শাসকের সামনে হক কথা বলা বড়ই কঠিন। কেননা শাসকেরা সমালোচনাকে সহ্য করতে পারে না। তাদের সামনে পেছনে যারাই থাকে তারা শুধু তোয়াজই করে। এজন্য বলা হয় সরকার ভুল করে। কিন্তু জনগণ ভুল করে না।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হয়নি। যারাই ক্ষমতায় ছিলেন তারাই তাদের মনোঃপুত কমিশন গঠন করেছে। যে কারণে নির্বাচন কমিশন সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার সৎ সাহসটুকু রাখে না। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ভোটারবিহীন নির্বাচনের যে ঢেড লেগেছে তা দূরীভূত করতে না পারলে ভোট শব্দটিও অভিধান থেকে উঠে যাবে। উৎসবের ভোট ভোটারবিহীন হলেও তো ব্যয় হয়। নির্বাচন কমিশন কেন এত বিশাল বাজেটের ব্যয় করে তামাশার ভোট করছে তা বোধগম্য নয়। জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে কোনো কিছুরই কমতি বা ঘাটতি ছিল না। তবু আজ্ঞাবহ কমিশন ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। উপজেলা পরিষদের প্রথম পর্বের নির্বাচনে অধিকাংশ কেন্দ্রই ফাঁকা ছিল। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যরা কার্যত অলস সময় কাটিয়েছে। পত্রিকান্তরে জয়পুরহাটের সদর উপজেলার সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটচিত্রে এমনটিই দেখা গেছে। কেন্দ্রের বিভিন্ন ভোটকক্ষে বসে আছে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ২২ জন কর্মকতা। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে ১৪ জন কর্মকর্তা ছিল। ভোট নেয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। ভোট গ্রহণের সময় শুরু হলের ভোটারের অপেক্ষা করছে দায়িত্বে থাকা জনশক্তি। কিন্তু ভোটারের দেখা নেই। প্রথম দেড় ঘন্টায় ৩ জন ভোটার এলেন। সারাদিনে মাত্র ৬৭টি ভোট পড়েছে। পত্রিকাটির তথ্যমতে, ওই ভোট কেন্দ্রে নারী ভোটারদের সংখ্যা ২ হাজার ৫১১। ভোট পড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অন্য একটি ভোট কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১৫০টি। এটা থেকে কী প্রমাণ হয় না, মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে অনীহা প্রকাশ করছে।

উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের উৎসবের আমেজের পরির্বতে হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিরাজ করছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে প্রথম ধাপের নির্বাচনে মাত্র ৩৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করেন প্রথম ধাপে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচনের প্রতি এদেশের মানুষের আগ্রহের কোন কমতি নেই। অথচ এবারের প্রতিটি নির্বাচন কী জাতীয় কী স্থানীয় কী ডাকসু সব কয়টি নির্বাচন কলংকিত হয়েছে। অনেক উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকারী দলের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছে। পত্রিকান্ততে জানা গেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৯৬ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ নেই। ভোট ও নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। কারণ ভোট এখন আর মানুষকে দিতে হয় না। ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়। এমনকি যাকে ভোট দিল তার পক্ষে গণনা করা হবে কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় না। অনেকে ভোট দিতে গিয়েও ভোট দিতে পারেনি। কারণ ক্ষমতার দাপটের কাছে সাধারণ মানুষ হেরে যায়।

আমরা কখনোই মন্দের ভালো কিংবা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন প্রত্যাশা করি না। তবু একপেশী হওয়ার কারণে প্রতিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সুনাম এখন তলানীতে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মারাত্মক সব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিনে বিরোধীদলীয় সদস্যদের ওপর হামলা। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন। ভোট জালিয়াতি। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ। তারা আরো বলেছে, সহিংসতা,বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার ও স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন করা হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে হয়ে যাওয়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের পক্ষে মত দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাযথ হয়নি বলে মন্তব্য করে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় একটি ইতিবাচক ফলের জন্য রাজনৈতিক সব পক্ষকে নিয়ে অর্থপূর্ণ সংলাপের তাগিদ দেয় সংস্থাটি।

উপজেলা নির্বাচন উৎসবমুখর হবে এমনটি অনেকে ভেবেছেন। কিন্তু নির্বাচনের এ কী হাল! ১০ মার্চ থেকে সারা দেশে উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের ভোটের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে উৎসবের ভোটের সংস্কৃতি জোয়ার ভাটায় বালির সাথে মিশে গেছে। দেশের প্রধান বিরোধীদলগুলো উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। ফাঁকা মাঠে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামীলীগ। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মানুষ নাকি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে ৭০ সালের মতো। তাহলে মাস কয়েক এর ব্যবধানে দলটির নেতা কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে ভোটার নিতে ব্যর্থ হলেন কেন? এই বিষয়টি জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন। দলটির নেতা কর্মীরা ৮০ শতাংশ ভোটের দাবি করলেও তাদের ভোটার সংখ্যা হয়তো হতে পারে ৪০ শতাংশ। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ৪০ শতাংশ ভোট ব্যাংক তাদের রয়েছে। যদি সত্যিই তাদের কর্মী সমর্থক বাড়তো তাহলে ভোটকেন্দ্রের উপস্থিতি এত কম হতো না। আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকলে ভোটারের দীর্ঘ লাইন সবারই চোখে পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম ভোটকেন্দ্রগুলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর মতোই ফাঁকা। ১০ মার্চ প্রথম ধাপে ৭৮টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার সিটি করপোরেশন মতো হতাশাব্যঞ্জক ছিল বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর যেসব অনিয়ম,দুর্নীতি, ভোট জালিয়াতি হয়েছে,উপজেলা নির্বাচনে তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই নয়,প্রাচ্যের অক্সফোড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেও ভোট জালিয়াতির মহাউৎসব দেখে দেশের সচেতন মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। এ নির্বাচনেও আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধার,শক্তি প্রয়োগ,হানাহানিসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন আর ডাকসু নির্বাচন কার্যত সিল মারার উৎসবে একাকার হয়ে গেছে। দেশের সন্তানতুল্য নাগরিকেরা আশা করেছিল ডাকসু নির্বাচন যেন ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো কলংকিত না হয়। কিন্তু সে আশা জাতির পূরুন হলো না। ডাকসুতেও কলংকের দাগ পড়ল।

বৃটিশরা যখন বিশ্ব শাসন করতো তখন তারা এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করেছিল,সেখানে সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। যারা কর প্রদান করতো এবং শিক্ষিত ছিল তারাই কেবল ভোট দিতে পারতো। বৃটিশদের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু তীব্র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে ভোটাধিকার আজ উধাও। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে শুরু করে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন,ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচন,পরিবহন সমিতির নির্বাচনেও ভোট উধাও।

সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনের যতগুলো সংগঠন রয়েছে তার সিংহভাগ থেকে যেখানে ভোট উধাও সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোটের আশা করা বোকার স্বর্গে বাস করা। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে এদেশের গণতন্ত্র এখন খাদের কিনারায়। ভোট ও নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ ভোট এখন আর মানুষকে দিতে হয় না। নির্বাচনের পুরো বিষয়টি এখন কারসাজিতে পরিণত হওয়ায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারনে মানুষ ভোট দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। গণতন্ত্র নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূণ উপাদান। গণতন্ত্র আছে কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই,সে নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচন ব্যতীত আর কী বলা যেতে পারে? আমরা আশা করব ক্ষমতাসীন শাসক জনগণের মনের দ্রোহটা অনুধান করে ভোটারবিহীন উপজেলা নির্বাচনের কলংকের দাগ দূরভীত করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে এমনটি দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা।

http://www.dailysangram.com/post/370964