৩১ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৯:২৭

বনানী এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি

কার কথা সত্য, দায়ী কে

১৮ থেকে ২৩ তলার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক -দাবি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপের * এ ধরনের কোনো কাগজ নথিতে নেই-রাজউক চেয়ারম্যান * এটি তো ভয়াবহ বিস্ময়কর তথ্য, এই জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতেই হবে -ড. আদিল মুহাম্মদ খান

বনানীর এফআর (ফারুক-রূপায়ন) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নকশাবহির্ভূত ৫টি ফ্লোরের অনুমোদন নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপ দাবি করছে তারা নকশা সংশোধন আবেদনের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়েছে।

বিপরীতে রাজউক বলছে, এ ধরনের অনুমোদন তারা দেয়নি। কোনো নথিতে এর প্রমাণও নেই। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার এফআর টাওয়ার নির্মাণে নানা ত্রুটি নিয়ে যখন চারদিকে ক্ষোভ-অসন্তোষের হইচই চাউর হচ্ছে, হতাহতের পরিবারে চলছে ক্ষোভ আর শোকের মাতম, তখন এ রকম খবরে বিস্মিত সবাই।

বিতর্কিত এফআর টাওয়ার ভবনের নির্মাণ সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে শনিবার যুগান্তরের কাছে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য আসে। তবে বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ বিস্তারিত জানাতে চাননি। সূত্র জানায়, আজ এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে রাজউকে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রোববারের মধ্যে তিনি এ বিষয়ে সদুত্তরসহ নথিটির বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে চেয়েছেন।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, এটি তো ভয়াবহ বিস্ময়কর তথ্য, এই জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতেই হবে।

তিনি আরও বলেন, এফআর টাওয়ার ২৩ তলা বৈধ ধরে নিলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপ বহু অনিয়ম করেছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে তারা নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধামতো ভবন নির্মাণ করেছে। যেখানে প্রয়োজনীয় খালি জায়গা রাখা হয়নি। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এসব অপরাধের দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। পাশাপাশি এগুলো তদারক করার দায়িত্ব যাদের তাদের চরম ব্যর্থতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ এখন আর কোনো কারণ শুনতে চায় না। তারা ন্যায্য বিচার চায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর ১৮ তলাবিশিষ্ট বহুতলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেয় জমির মালিক ইঞ্জিনিয়ার এসএমএইচআই ফারুক। এরপর তিনি নিজ খরচে ওই ভবনের ফাউন্ডেশনের কাজ শেষ করেন। পরে ২০০৩ সালে রূপায়ন গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে ভবন নির্মাণের চুক্তি করেন জমির মালিক। রাজউকের মাধ্যমে রূপায়ন গ্রুপকে আমমোক্তারনামা দেয়া হয়।

যেখানে বলা হয়েছে, ভবনের ৫৫ ভাগ অংশ পাবে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এবং ৪৫ ভাগ অংশ পাবেন জমির মালিক। ২০০৮ সালে ওই ভবনের কাজ সম্পন্ন করে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান জমির মালিক ও ক্রেতাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেয়।

এরপর সব মালিককে নিয়ে একটি অ্যাডহক কমিটি করে দেয় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপ। এরপর থেকে ওই কমিটির সদস্যরা ভবনের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা কেনা করা হল সে বিষয়ে রূপায়ন গ্রুপ ও রাজউক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে।

রূপায়ন গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) সাইফুল ইসলাম যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, এফআর টাওয়ার যথাযথ নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। রাজউক থেকে প্রথমে ওই ভবনের ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

পরে আরও পাঁচ তলার অনুমোদন করেছে রাজউক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক বা অন্যান্য সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা নির্মাণ করা হয়েছে। এটা একেবারেই ঠিক নয়, আমাদের কাছে সব ডকুমেন্ট (প্রমাণপত্র) রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বনানী এফআর টাওয়ারের ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন ছিল। কিন্তু জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২৩ তলা পর্যন্ত করেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো কিছু দাবি করলেই সেটা সত্য হয়ে যাবে না। আমাদের কাছে কাগজপত্র থাকতে হবে। রাজউকে এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণপত্র রাজউকে খুঁজে পাইনি।’

এদিকে রাজউক চেয়ারম্যানের এমন দৃঢ় অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললে রূপায়ন গ্রুপের ডিজিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন রাজউক যদি বলে তাদের বর্ধিত ফ্লোর অনুমোদনের কাগজ নেই তাহলে এ দায় রাজউকের।

এ সময় তিনি দাবি করেন, রূপায়ন গ্রুপ এফআর টাওয়ারের নির্মাণ কাজ চলাকালীন ২০০৫ সালে রাজউকের কাছে ওই ভবনের সংশোধিত নকশা জমা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, এফআর টাওয়ার ১৮ তলার পরিবর্তে ২৩ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করতে চান তারা। রাজউকের তৎকালীন এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা রূপায়ন গ্রুপের সংশোধিত নকশা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে অনুমোদন করে।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকার যুগান্তরকে বলেন, বনানী এফআর টাওয়ারের অনিয়ম তদন্তে জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে তলব করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা যাচাই-বাছাই করা হবে। যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, ওই কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। ওই প্রতিবেদনে এফআর টাওয়ারের সব তথ্য বেরিয়ে আসছে।

প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান শহরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন নকশা করছে, যেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন- বহুতলা ভবনগুলো স্পেস বাড়াতে দেয়ালের পরিবর্তে কাচ লাগানো হচ্ছে।

এতে করে ভবনের বাতাস দ্রুত ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আর বাইরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে না; এসব নানান অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। তিনি আরও বলেন, অতি মুনাফার লোভে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী ফায়ার সার্ভিস সিস্টেম গড়ে তোলে না। এসব কারণে প্রায়ই বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া নকশাবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণের দায়েও অভিযুক্ত ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ বহুতলা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে জমির মালিক, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের সমান ব্যর্থতা দায়ী।

তিনি আরও বলেন, রাজধানীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য রাখতে হলে ভবনগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ প্রতি বছর পানি-বিদ্যুৎ ও গ্যাস সেবার সংযোগগুলো নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজউক, ফায়ার সার্ভিস বা অন্য সেবা সংস্থাগুলোর সেদিকে তেমন কোনো দৃষ্টি নেই। এ দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/161181