৩১ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৯:১৭

আবার বাকশালের প্রশংসা একদলীয় রাষ্ট্রের পথে বাংলাদেশ?

৪৪ বছর পর বাংলাদেশে আবার বাকশালের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে। গত ১৯ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ এই ৭ দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তত ২টি অকেশনে বাকশালের গুণগান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে ৪৪ বছর পর অকস্মাৎ বাকশালের গুণকীর্তনের ফলে নিরপেক্ষ সুধী সমাজ বিশেষ করে বিএনপি ঘরানায় নতুন করে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল এবং সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আশঙ্কা করছেন যে সরকার কি তাহলে আইন করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার দিকে এগুচ্ছে? এতদিন ধরে সকলেই বলে আসছিলেন যে এবার সরকার একদলীয় শাসন ঠিকই প্রতিষ্ঠা করবে, তবে ১৯৭৫ সালের মতো হাঁক ডাক করে আইন করে বাকশাল কায়েম করবে না। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ২ মাস ২০ দিন পর প্রধানমন্ত্রীর মুখে বাকশালের জয়গান শুনে এখন তারা মনে করছেন যে বর্তমান সরকার হয়তো আর কোনো কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করবে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত ১৮ মার্চ এক আলোচনা সভায় রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) কার্যকর থাকলে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতো না। তিনি বলেন, বাকশাল ছিলো সর্বোত্তম পন্থা। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যে পদ্ধতিটা (বাকশাল) করে গিয়েছিলেন সেটা যদি কার্যকর করতে পারতেন তাহলে এসব (নির্বাচনী অস্বচ্ছতা) প্রশ্ন আর উঠতো না।

গত ১৮ মার্চ সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অধুনালুপ্ত একটি রাজনৈতিক দল যা সচরাচর বাকশাল নামে পরিচিত। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাকশাল নামক এই একক রাজনৈতিক দল গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই বৎসর ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাকশাল বিলুপ্ত হয়।

বঙ্গবন্ধু সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির ৭ ভাগ উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন, আজ নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা ওঠে, আর আমাদের বিরোধী দল বাকশাল বাকশাল করে গালি দেয়। তারা যদি একবার চিন্তা করতেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন একটা বিপ্লবের পর যেকোন দেশে একটা বিবর্তন দেখা দেয়। সেই বিবর্তনের ফলে কিছু মানুষ হঠাৎ ধনীক শ্রেণিতে পরিণত হয়। আবার ভালো উচ্চবিত্ত মানুষ তাদের ধন-সম্পদ ধরে রাখতে পারে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সুনিশ্চিত করা এবং ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা একান্তভাবে দরকার। সব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু এমন একটি পদ্ধতি এনেছিলেন যেখানে কেউ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যে প্রার্থী হবে সকলের নাম একটি পোস্টারে দিয়ে প্রচার করা হবে। যে ব্যক্তি যত বেশি জনগণের কাছে যেতে পারবে, জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে সেই শুধু নির্বাচিত হবে।

পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন করে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি একবার তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, কেন তিনি (বঙ্গবন্ধু) এই পদ্ধতি চালু করছেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, একটা বিপ্লবের পর কিছু মানুষের হাতে অর্থ চলে আসে। আমি চেয়েছি নির্বাচন যেন অর্থ এবং লাঠি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়। জনগণের কাছে যেন ভোটের অধিকারটা থাকে, প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকারটা থাকে। তা নিশ্চিত করবার জন্যই আমি এই পদ্ধতিটা শুরু করেছি।

॥দুই॥
২০১৯ সালে এসে জোর গলায় বলা হচ্ছে বাকশাল বাংলাদেশের জন্য উপযোগি ছিলো। এটা বাংলাদেশের জন্য যে কতটা উপযোগী ছিল একসময় বাংলাদেশের মানুষ তা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধু যে পদ্ধতিটা করে গিয়েছিলেন সেটা যদি কার্যকর করতে পারতেন তাহলে এসব প্রশ্ন (নির্বাচনে অস্বচ্ছতা) আর আসতো না। সব থেকে জনদরদী যে ব্যক্তিটি জনসেবা করে সেই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারতেন। অতীতে শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন এবং এবারও সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে শেখ হাসিনা বলেন যে, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই শেখ মুজিব বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চিন্তা ভাবনা করেন।

১৮ মার্চের পর ২৫ মার্চ শেখ হাসিনা আবার বাকশালের কথা বলেন। গত ২৫ মার্চের আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘১৯৭৫-এর পর নির্বাচন ব্যবস্থা ধসে পড়া এবং শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও অপরাজনীতির অনুপ্রবেশের কারণেই তার পিতা কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা দলগুলো ৭টি আসনের জয়লাভ করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা কখনও নির্বাচনে জয়ী হতে পারে না, সেসব রাজনৈতিক দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতির পিতা বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গড়েছিলেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি প্ল্যাটফর্ম ছিলো এই বাকশাল, যেখানে ঐক্যের মধ্য দিয়ে সকলেই দেশের কাজ করবে এবং সেখানে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে তিনি উন্নয়নের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

তিনি আরো বলেন, ‘জাতির পিতা যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সেটা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে আর কেউ খেলতে পারতো না। নিজের মনের মতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জনগণ নির্বাচিত করতে পারতো। জাতির পিতা সেসময় নির্বাচনের যে পদ্ধতি করেছিলেন, সে অনুযায়ী যার যার নির্বাচন সে সে করতে পারবে। নির্বাচনের খরচ প্রতিটি প্রার্থীকে দিয়ে দেয়া হবে রাষ্ট্রের তরফ থেকে। প্রতি আসনের জন্য পৃথক একটি করে পোস্টারে সকল প্রার্থীর নাম ছাপিয়ে দেয়া হবে। কাজেই জনগণের সাথে যার যোগাযোগ আছে, সম্পৃক্ততা আছে তারা নির্বাচিত হবেন। অর্থাৎ ভোটের অধিকার তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে যাতে পৌঁছায়, তাঁরা যেন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, সেই সুযোগ তিনি করে দিয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘তিনি বেঁচে থাকলে আর ৫-৭ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত এবং সমৃদ্ধশালী হয়ে গড়ে উঠতে পারতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেও বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এবার তিনি যেভাবে এর খুঁটিনাটি উল্লেখ করে বাকশাল পদ্ধতির প্রশংসা করেছেন এবং তা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে যে তিনি আবার একদলীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। এর আগে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই অনানুষ্ঠানিক এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন যে তিনি তার পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। তবে সেটা তিনি আইন দিয়ে করবেন না। সেটা তিনি করবেন বিদ্যমান আইন দিয়ে এবং প্রশাসন দিয়ে।

॥তিন॥
এখানে কয়েকটি বিষয়ের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় যেটিকে কাকতালীয় বলা যাবে না। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার স্থপতি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৯৩টি আসন। অবশিষ্ট ৭ টি আসনের মধ্যে নির্দলীয় ৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ১ এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১। গত ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এবং তার আজ্ঞাবাহী জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২৯২টি আসন। অবশিষ্ট ৮টি আসন পেয়েছে বিরোধী দল। এর মধ্যে গণফোরামের সুলতান মনসুর শপথ নেওয়ায় বিরোধী দলে রয়েছেন বিএনপির ৬ এবং গণফোরামের ১, মোট ৭টি আসন। সে জন্যই বলছিলাম ৭৩ সালের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্যে কি অদ্ভুত মিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ২ বছর ১০ মাসও পার হয় নি। সবগুলো দল বাতিল করে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি বাতিল করে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির অধীনে একদলীয় বাকশাল কায়েম হয়। এবারও বিরোধী দলে রয়েছেন মাত্র ৭ জন সদস্য। তারাও আবার এপর্যন্ত শপথ গ্রহণ করেন নি। এর মধ্যেই বাকশালের আওয়াজ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে একবার যখন বাকশাল বা একদলীয় শাসনের কথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে বেরিয়েছে তখন তিনি সেটা কায়েম করেই ছাড়বেন। ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে তার আলামত। টেলিভিশনের টকশোত দেখা যাচ্ছে যারা খাস আওয়ামী লীগার তারা বাকশালের প্রশংসা করে শেখ হাসিনার উক্তির প্রতিধ্বনি করছেন। অতীতে সারা দেশ যেখানে একদলীয় এক নায়কত্বের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এবার শেখ হাসিনা সেই একদলীয় শাসনের কথা উচ্চারণ করলেও কোনো প্রতিবাদ নাই। কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো কিন্তু সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। এবারের ক্যাবিনেটে তিনি রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুকে বাদ দিয়েছেন। বাদ দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরীকে। বাদ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে। জাতীয় পার্টিকেও ক্ষমতা থেকে আউট করে দিয়েছেন। ১৪ দলীয় মহাজোট নিয়ে এক সাথে ইলেকশন করলেও সরকার গঠনের সময় তিনি সব দলকে বিদায় করে দিয়েছেন। এখন শুধু তার নিজ দলেরই ক্যাবিনেট। অর্থাৎ ওয়ান পার্টি ক্যাবিনেট। এটিকে যদি একটু ঘুরিয়ে বলা যায় যে ওয়ান পার্টি স্টেট, অর্থাৎ একদলীয় রাষ্ট্র তাহলে সম্ভবত ভুল বলা হবে না। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনী ফলাফল দেখে অনেকে হতভম্ব হয়েছেন। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মহল ভেবেছিলেন যে, অন্তত ৭০/৮০টি আসন বিরোধী দলকে দেয়া হবে। সেখানে বিরোধী দলকে যখন মাত্র ৮ টি আসন দেওয়া হয় তখন থেকেই অভিজ্ঞ মহলের অত্যন্ত খটকা লাগে। ৫০/৬০টি আসন দিলেও সরকারের কোনোই ক্ষতি হতো না। কিন্তু সেখানে ৫০/৬০ তো দূরের কথা, দেয়া হলো মাত্র ৮ টি আসন। তাও আবার এই ৮ জনের মধ্যে একজন দল ছুট।

সেদিন পর্যবেক্ষক মহল নিজেদের মধ্যেই আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন ৬০/৭০টি আসন বিরোধী দলকে দিলে শেখ হাসিনার কি ক্ষতি হতো? সেদিন অনেকে এই কথার জবাব পাননি। বিরোধী দলকে মাত্র ৮টি আসন দেওয়ার শানে নযূল এই আড়াই মাস পর পরিস্কার হচ্ছে। যতই দিন যাবে ততই পরিস্কার হবে। আল জাজিরার তুখোড় সাংবাদিক মেহেদী হাসানের মতে বাংলাদেশে একদলীয় রাষ্ট্র ও সরকার ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সরকার এখন তার অবস্থান সংহত করার কাজে ব্যস্ত।

Email:asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/370379