হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির কারণে বনানীর আরএফ টাওয়ারে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে বিঘ্ন ঘটে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের
৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:২৮

অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত: কমিটির পর কমিটি সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই

বনানীর ঘটনায় ৬ কমিটি

রাজধানীর পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা। এরপর রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর বহুতল ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। নিমতলীর আগে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজধানীর একটি বড় শপিং সেন্টারে ভয়াবহ আগুন লাগে। ২১ তলা ভবনের ১৩ তলা থেকে ১৮ তলা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

এ ঘটনায় সাতজন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। তাছাড়া প্রতিনিয়তই ঘটছে চোট-বড় অগ্নিদুর্ঘটনা। এসব ঘটনায় একের পর এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে নানা সুপারিশ। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন নেই। এ কারণে কমছে না অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও।

২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর উচ্চপর্যায়ের কমিটি ১৭ দফার সুপারিশ করে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে গত মাসে চুড়িহাট্টায় বা বৃহস্পতিবার বানানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ মার্চ রাতে চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনে ৭০ জনের বেশি মানুষ মারা যান। এ ঘটনায় ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সবগুলো কমিটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি প্রতিবেদনের সবগুলো সুপারিশ।

এরই মধ্যে ঘটল বনানী এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা। এ ঘটনায় এরই মধ্যে ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে শুক্রবার থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে আহ্বায়ক করে ৬ (ছয়) সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ নির্ণয়সহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে মতামত ও সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

ভবনের নকশা অনুমোদন এবং নির্মাণসংক্রান্ত কোনো কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ৬ (ছয়) সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইয়াকুব আলী পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ফাহিমুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিকেও ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের আরও একজন অতিরিক্ত সচিব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, বুয়েট ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে সদস্য রাখা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে উপ-পরিচারক দেবাশীষ বর্ধনকে আহ্বায়ক ও সহকারী সালেহ উদ্দিন আহমেদকে সদস্য সচিব করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) পক্ষ থেকে আট সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইইবির সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল হুদাকে আহ্বায়ক এবং আইইবির সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়।

এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক খন্দকার ওয়ালিউর রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বুয়েট-জাপান ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন অ্যান্ড আরবান সেফটির পরিচালক ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. রাকিব আহসানের মতে, প্রতিটি অগ্নিদুর্ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয় সেগুলো বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি।

তিনি বলেন, মহানগরীর কোন কোন এলাকা অগ্নিকাণ্ডের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মহড়া কর্মসূচি চালানো উচিত। তাতে পূর্ব প্রস্তুতির কাজটা হবে। মহড়ায় সব সংস্থার সমন্বয় থাকতে হবে। মহড়ার সময় মানুষ যাতে জমায়েত হতে না পারে তার জন্য ভবনের সামনে বা আশপাশের রাস্তা বন্ধ রাখতে হবে। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের পর দেখতে পেলাম সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। এর ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স বা জরুরি সেবা সংস্থার গাড়ি ঢুকতে বেগ পেতে হয়েছে। এটা হয়েছে পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায়।

১৭ দফায় যা ছিল : নিমতলী ট্র্যাজেডির পর যে ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলো হল- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া বাড়ানো, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিম্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, বাড়িঘরে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে মাসে অন্তত একবার ট্রান্সফরমার সরেজমিন পরীক্ষা করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিক জাতীয় দাহ্য বস্তুর সব দফতরের মধ্যে সমন্বয়, চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সাজ-সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, সচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধারকাজে বিঘœ ঘটাতে না পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয় বাধ্যতামূলক করা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা।

চুড়িহাট্টার সুপারিশ : চুড়িহাট্টার ঘটনায় আইইবির তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে- আইন ও বিধির অসামঞ্জস্যতা অবসানে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা। সে কমিটির মাধ্যমে সংস্থাগুলোর সব আইন ও বিধির সমন্বয় করে নতুন একটি সমন্বিত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা। যার যার কর্মপরিধি অনুযায়ী সমন্বিতভাবে কার্য সম্পাদন করা ও কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করা।

এ কাজগুলোর সমন্বয়ের জন্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের কাছে দায়িত্ব দেয়া। তা না হলে দুই সিটিসহ রাজউকের অন্তর্গত ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা।

এতে আরও বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু এবং সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। এ এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

কেরানীগঞ্জ বা সাভারে কেমিক্যাল পল্লী গঠনের মাধ্যমে দাহ্য পদার্থের গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে আইইবি। রাসায়নিক ব্যবসায়ী, গুদামজাত ও পরিবহনে নিয়োজিত সবাইকে এর ব্যবহার ও সংরক্ষণের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিস্ফোরক দ্রব্যাদির আমদানি, মজুদ, বিতরণ ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করার ওপর জোর দিয়েছে আইইবি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনসিসি) এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজউক ও সিটি কর্পোরেশন আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়াগ নিশ্চিত করা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/160843