অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানী, সর্বত্রই উদাসীনতা
৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:২৪

অগ্নিঝুঁকিতে রাজধানী, সর্বত্রই উদাসীনতা

একাধিক অগ্নিদুর্ঘটনার পরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই * নির্মাণ বিধিমালার আধুনিকায়ন চূড়ান্ত হয়নি ৯ বছরেও * ভবনের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে- ইকবাল হাবীব * বাড়াতে হবে ফায়ার স্টেশন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি- ব্রি.জে. আলী আহমেদ খান

একের পর এক অগ্নি দুর্ঘটনায় ঝরছে মূল্যবান প্রাণ। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে বনানীর মতো অভিজাত এলাকাও বাদ যাচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডের পর তাৎক্ষণিকভাবে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও কিছুদিন পর সেই আগের অবস্থায় চলতে থাকে সবকিছু। সামগ্রিকভাবে কোনো কিছু গড়ে উঠছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবস্থা এতটাই খারাপ যে ২০১০ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আধুনিকায়নের কাজ শুরু হলেও গত ৯ বছরেও তা চূড়ান্ত হয়নি। কয়েক দশক ধরে রাজধানীকে ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী করার কাজটি সম্পন্ন করা হলেও অগ্নি নির্বাপণের জন্য নেই ন্যূনতম প্রস্তুতিও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর ফুটপাতে জলাধার রাখা আদর্শ মহানগরীর অন্যতম শর্ত। পানির অভাবে আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীর বেগ পাওয়ার বিষয়টি প্রতিনিয়তই চোখে পড়ছে। অথচ সব ক্ষেত্রেই উদাসীনতার চিত্র।

কথা হয় বিশিষ্ট নগরপরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবীবের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ৪ থেকে ৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০-২০ তলা ভবন। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সময়োপযোগী করতে ২০১০ সালে বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। দীর্ঘ ৫ বছর গবেষণার পর খসড়া প্রস্তুত হয় ২০১৫ সালে। এরপর চার বছর কেটে গেলেও চূড়ান্ত হয়নি।

রাজধানীর ভবনগুলোতে সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি কমপ্লায়েন্স কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রানা প্লাজার পর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোকে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, রাজউককে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ না বলে, রাজধানী অবনয়ন কর্তৃপক্ষ বলাই ভালো। ভবন নির্মাণের সময় নকশা অনুযায়ী বিদ্যুতায়ন ও এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, বহির্গমনের পথ, স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে রাজউককেই।

বুয়েটের জাপান ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন এবং আরবান সেফটি’র পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিদ এম আল হুসাইন যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকা সব জায়গাতেই অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে। আগুন কেন লাগে, কীভাবে ছড়ায় তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তাহলেই সীমাবদ্ধতাগুলো বেরিয়ে আসবে। রাজধানীর সুউচ্চ ভবনগুলোতে কোনো অ্যাভোকেশন প্ল্যান এবং অ্যাভোকেশন রুট নেই। ফলে যেকোনো ধরনের দুর্যোগে ভবনের বসবাসকারীরা বুঝতে পারে না, কী ঘটতে যাচ্ছে, কোন পথে বেরিয়ে যেতে হবে। ভবনগুলোতে ফায়ার অ্যালার্ম ব্যবস্থা নেই। থাকলে একটু ধোঁয়ার সৃষ্টি হলেই অ্যালার্ম বেজে উঠত। নেই ফায়ার স্টিংগুইশার, যেগুলো আছে সেগুলোর মেয়াদ নেই। থাকলেও বাসিন্দারা তার ব্যবহার জানে না।

তিনি বলেন, ভবনগুলোতে ফায়ার প্রুফ দরজা নেই, যেটি আগুনের তাপ ও দাহ্যতা থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে। উৎসুক জনতাও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থারও উন্নতি করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, উঁচু ভবনের জন্য আমাদের ল্যাডারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আধুনিক আরও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। ফায়ার স্টেশন বাড়াতে হবে, যাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সময় নষ্ট না হয়।

তিনি জানান, ভবনগুলোতে হাইড্রেন্ট, স্প্রিংলার সিস্টেম রাখতে হবে। এই পদ্ধতিতে কোনো তলায় ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা হলেই ওই পাইপ থেকে ঝরনার মতো পানি ঝরে পড়ে। ১০ ফুট পরপর স্প্রিংলার সিস্টেম বসাতে হয়। এই পদ্ধতিতে নিচে তিনটি পানির পাম্প থাকে, এই পাম্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। ফায়ার পাম্প চলে বিদ্যুতে। বিদ্যুৎ না থাকলে স্ট্যান্ডবাই পাম্প জেনারেটর চালু হবে, না হলে জকি পাম্প থাকে। জকি পাম্প প্রতিটি ফ্লোরে সমান গতিতে পানি ছিটায়।

এছাড়া রয়েছে পিএ সিস্টেম। এই পদ্ধতিতে নিচে একটি কন্ট্রোল রুম বা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকবে। সেই কক্ষ থেকে কন্ট্রোলার ওই ভবনের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বিএবিএক্সের মাধ্যমে কোন তলায় আগুন লেগেছে তা জানিয়ে দেবেন। থাকতে হবে স্মোক ডিটেক্টর বা ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র। এই যন্ত্র বসানো হলে কোনো তলায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর উপরে উঠলেই শব্দ করে ভবনের সবাইকে সতর্ক করবে।

থাকবে হিট ডিটেক্টর সিস্টেম। এই যন্ত্র বসানো হলে তাপমাত্রা বাড়লেই বেজে উঠবে। এ ছাড়া একজন অগ্নিনির্বাপক কর্মকর্তা থাকবেন, যিনি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সবকিছু তদারক করবেন। সুউচ্চ ভবনে হেলিপ্যাড থাকা বাধ্যতামূলক। প্রতি সাড়ে ৫০০ বর্গফুট আয়তনের জন্য একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে। প্রতি তিন মাস পরপর ফায়ার ড্রিল বা অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সুউচ্চ ভবনে কমপক্ষে দুটি সিঁড়ি থাকবে। কোনো ভবনে আগুন লাগলে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়ে ধোঁয়ার কারণে বের হতে পারে না। ফলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ কারণে প্রতি তলায় ‘এক্সিট সাইন বা প্রস্থান চিহ্ন’ থাকা আবশ্যক। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এটি আলো জ্বেলে পথ নির্দেশ করবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবীর যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর কোনো ভবনই নিয়ম মেনে করা হয় না। দেখার কেউ নেই। একই সময়ে যদি একাধিক স্থানে অগ্নিকাণ্ড হয় তাহলে সেটি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও নেই প্রতিষ্ঠানটির। তাই সামগ্রিকভাবে বলা যায়, নিরাপদ অগ্নিনির্বাপণে আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত নই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/160844