ছেলে আহমেদ জাফরের লাশ নিতে এসে ঢামেক হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন হতভাগ্য বাবা।
৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:১৮

এফআর টাওয়ারে আগুন: কান্নার রোল ঘরে ঘরে

বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের ২৪ জনকে শুক্রবার দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১২ জন, ঢাকার বাইরে ১২ জনকে দাফন করা হয়। একজনের লাশ শুক্রবার পর্যন্ত হস্তান্তর করা হয়নি।

ঢাকা বা ঢাকার বাইরে যেখানেই লাশ নেয়া হয়েছে, সেখানেই নিঃস্ব ও স্বজনহারা মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারি আর বিলাপে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। স্বপ্ন তছনছ হওয়া মানুষের আর্তনাদ শুনে নীরবে চোখের পানি ফেলেন অন্যরাও।

ঢাকার বাইরে যে ১২ জনকে দাফন করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগের বাড়ি উত্তরাঞ্চলে- নীলফামারী, রংপুর, নওগাঁ, বগুড়া ও পাবনায়। বরিশাল, টাঙ্গাইল, খুলনা, নোয়াখালীসহ অন্যান্য জেলায়ও আছে কয়েকজনের বাড়ি।

নিহতদের মধ্যে আছেন স্বামী-স্ত্রী মাকসুদার রহমান ও রুমকি বেগম। রুমকি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ঈদুল ফিতরের ছুটিতে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঈদের আগেই তারা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরেছে, লাশ হয়ে। মাকসুদারের বাড়ি পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। তার বাবা মিজানুর রহমান। রুমকির বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকায়। তিনি কৈমারী ইউনিয়নের আশরাফ আলীর মেয়ে।

বিন্যাকুড়ি গ্রামে শুক্রবার যখন রুমকির লাশ বাড়িতে পৌঁছায় তখন সেখানে কান্নার রোল ওঠে। রুমকির মেজ ভাই ও বিন্যাকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আলী রনি জানান, ১৭ মার্চ মোবাইল ফোনে ছোট বোন রুমকির সঙ্গে তার কথা হয়।

সে বলেছিল, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বেড়াতে আসবে। কিন্তু তা আর হল না। বোনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বড় ভাই রফিকুল ইসলাম রকি। বাবা আশরাফ আলী বুকের ধন মেয়ে ও জামাইকে হারিয়ে দিশেহারা। পাঁচ মাস আগে রুমকির মা মারা যান।

বনানীর আগুন কেড়ে নিয়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চর বানিয়াপাড়া গ্রামের ছেলে ইফতিয়ার হোসেন মিঠুর জীবন। ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রেখা খাতুন। শুক্রবার মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর তার বিলাপে উপস্থিত সবাই কেঁদে ফেলেন।

বুক চাপড়ে মা রেখা বেগম বলছিলেন, ‘গত পরশুদিনও অফিস শেষ করে ছেলে আমাকে মোবাইল ফোনে জিজ্ঞেস করেছে, মা তুমি ওষুধ খেয়েছো? তুমি হাইপ্রেসারের রোগী, সময়মতো ওষুধ খাবা। আব্বার শরীরের অবস্থা কি? কিন্তু এখন আর কে বলবে, মা তুমি ওষুধ খেয়েছো।’

শোকে কথা বলতে পারছিলেন না এই মা। কান্না অবস্থায় তিনি আরও বলেন, ‘কাল যখন আগুন ধরে কত দোয়া করেছি। আমার ছেলের এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেল! মিঠু আমার বড় সন্তান, তাকে ছেড়ে কি করে থাকব। আমার মিঠুর ছেলেটা এতিম হয়ে গেল। বাবা ছাড়া সে কীভাবে থাকবে!’

বিয়ে করার ইচ্ছা পূরণ হয়নি বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আরেক নিহত আমির হোসেন রাব্বির। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার চরপাড়া গ্রামের এই যুবক এফআর টাওয়ারের ১১ তলার ইকোলাইন বিডি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে গ্রামের বাড়িতে। শোকের মাতমে ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস।

একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা-মা। রাব্বির পিতা আইয়ুব আলী জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন রাব্বী। বিয়ে করবে বলে ঘর করতে কিছু ইটসহ সরঞ্জাম কিনে বাড়িতে রেখেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাড়িতে আসার কথা ছিল তার। কিন্তু আমার ছেলে এভাবে বাড়িতে আসবে ভাবতে পারিনি।

এভাবে মরদেহ দেশের যেখানেই গেছে, সেখানেই স্বজনদের কান্না, আহাজারি আর বিলাপে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। তারা বলছিলেন, এমন করুণ মৃত্যু যেন আর কারও ভাগ্যে না জোটে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/160841/