৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:১৫

অভিবাসন ব্যয় এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে

সৌদি আরব, ইরাক যেতে ৪ লাখ টাকা লাগছে ; অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে সার্ভার লক

কর্মীরা যাতে অল্প খরচে বিদেশে যেতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতিনিয়ত সভা সেমিনারসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বাস্তবে এটি কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে জনশক্তি প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয়ের এসব উদ্যোগকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত টাকার ৫-৬ গুণ টাকা আদায় করে কর্মী প্রেরণের ব্যবসা অনেকটা প্রকাশ্যে অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার কারণে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য অভিবাসন ব্যয় এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়ে গেছে।

যদিও সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে গিয়ে দেশটির শ্রম উপমন্ত্রীর সাথে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ ফলপ্রসূ বৈঠক করেছেন। দুই দেশ ভিসা ট্রেডিং বন্ধে একমত পোষণ করেছে বলে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল। এর পরও ভিসা ট্রেডিং আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। যার ছায়া এসে পড়ছে এ দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমানো অসহায়-গরিব দরিদ্র শ্রেণীর মানুষগুলোর ওপর।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন ব্যয় কমাতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং না থাকায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এ সেক্টরকে অনেকটা জিম্মি করে ফেলছেন। এটি অবশ্যই দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা। তারা বলছেন, একজন কর্মী বিদেশে গিয়ে দুই বছরে যে টাকা উপার্জন করছেন তার বেশির ভাগই দিয়ে দিতে হচ্ছে দুই দেশে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধি ও ঢাকার স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীদের। ফলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা উপার্জন করেও শেষ পর্যন্ত কর্মীর নিজস্ব কোনো অর্জন (নগদ টাকা) থাকছে না।

এ দিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ দেশের বাইরে থাকার সুযোগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অভিনব কৌশলে চলছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ‘সব কিছুই চলছে আগের মতো’।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জনশক্তি রফতানিতে হঠাৎ করে ধস নামে; যা এখনো অব্যাহত আছে। তবে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ কাতারে কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসায় দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন পদ্ধতি না থাকায় কর্মী যাওয়ার হার বেড়েছে। তবে নতুন নিয়মে ‘ঝুঁকি’ নিয়ে কর্মী যাওয়ার পর তারা ঠিকমতো বেতন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন কি না সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে শ্রমবাজারে সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে সৌদি আরব আর মালয়েশিয়ার বাজারে। এই বৃহৎ দু’টি শ্রমবাজারের মধ্যে সৌদি আরব খোলা থাকলেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে। হঠাৎ এমন ধাক্কা লাগার কারণে পুরো শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই চিত্র ওমান, বাহরাইনসহ অন্যান্য দেশের কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রেও বলে জনশক্তি ব্যুরোর বহির্গমন শাখা সূত্রে জানা গেছে। অভিবাসন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততারা বলছেন, সৌদি আরবের শ্রমবাজার এ মুহূর্তে খুবই খারাপ। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে তাদের লোকজনই বেকার। এ অবস্থায় দেশটির বিমানবন্দরসহ প্রতিটি সেক্টরেই সৌদিকরণ নীতির আওতায় তাদের নারী-পুরুষরা চাকরি করছেন। এতে বিদেশী কর্মীর চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি আকামা ফিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে।

এসব কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় ওই দেশ থেকে চলে আসছেন। এর পরও সৌদি আরবের যেসব বড় বড় কোম্পানিতে কর্মী নেয়ার জন্য চাহিদাপত্র (ডিমান্ড লেটার) ইস্যু হচ্ছে সেগুলোকে পুঁজি করে একশ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও তাদের প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ আদায় করে কর্মী পাঠানোর ব্যবসা চালাচ্ছেন প্রকাশ্যে। শুধু সৌদি আরব নয়, ইরাকেও শ্রমিক প্রেরণে নেয়া হচ্ছে অত্যধিক অভিবাসন ব্যয়; যা কখনো কখনো ৫ লাখ টাকা পর্যন্তও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী ও প্রতারিতদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নয়াপল্টন ভিআইপি টাওয়ারের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ওভারসিজ নামের একটি রিক্রটিং এজেন্সি সৌদি আরব, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে জরুরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কর্মী সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির রিক্রুটিং ম্যানেজার মো: সাগর চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ডসহ ফটোস্ট্যাট করা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলো আগতদের হাতে দেয়া হচ্ছে।

ওই জরুরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, সৌদি আরবের মিনিস্ট্রি কোম্পানিতে বলদিয়া ক্লিনার হিসেবে ২৫ জন কর্মী নেয়া হবে। বেতন ১১০০ রিয়াল। থাকা ফ্রি। অন্য দিকে জেসারি কোম্পানিতে ফার্নিচার শো রুমম্যান পদে ১০০ জন কর্মী নেয়া হবে। খাওয়া নিজের, থাকা ফ্রি। বেতন ১২০০ রিয়াল। এই দু’টি কোম্পানিতে যেতে হলে প্রতিষ্ঠানের রেট ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যদিও সঙ্কেতে টাকার পরিমাণ লেখা রয়েছে ২৮০=। এভাবেই ‘মার্কেট ক্লিনার’ পদে ৩ লাখ, ফাস্টফুড, বয়/ক্লিনার পদের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে ইরাকের কেসন কোম্পানি লিমিটেডে ‘ক্লিনার পদে’ ১০০ জন কর্মী নিয়োগের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছেÑ থাকা ও খাওয়া ফ্রি। বেতন ৪০০ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় ৩৪ হাজার টাকা। এজেন্সি ফি লাগবে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সাঙ্কেতিকভাবে লেখা রয়েছে ৩৭০=। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া ওভারসিজ নয়, বর্তমানে জনশক্তি প্রেরণকারী বেশির ভাগ এজেন্সি কর্মী প্রেরণের নামে ৪ লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা আদায় করছে। এর মধ্যে অবশ্য দালালদের কমিশন ও জনশক্তি ব্যুরোর নামে বিভিন্ন খরচও রয়েছে। আর ভিসা সত্যায়িত হলে তো সে ক্ষেত্রে ব্যুরোর সিন্ডিকেটকে দিতে হচ্ছে প্রতি ভিসার বিপরীতে ৩৭ হাজার টাকা।

গতকাল শুক্রবার রাত সোয়া ৭টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ওভারসিজের রিক্রুটিং ম্যানেজার সাগর চৌধুরীর সাথে পরিচয় গোপন রেখে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা বেশি নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বর্তমানে ভিসার দাম বেশি, টিকিটের দামও বেশি। প্রতিটি ভিসা টিকিটে আমাদের ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। সামনে আরো খরচ বাড়বে। গতকাল শুক্রবার রাতে অভিবাসন ব্যয় প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমদ মনিরুছ সালেহিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অবশ্য নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে যা যা করা দরকার তার সবই করব। তার আগে ওই এজেন্সির সার্ভার লক করে দেবো।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/399158