৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:১১

শোকে স্তব্ধ দেশ

এফ আর টাওয়ারে উদ্ধারকাজ সমাপ্ত

রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনে প্রাণহানির ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশ শোকে স্তব্ধ। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে আছে ২২ তলা ফারুক-রূপায়ণ (এফ আর টাওয়ার) ভবনটি। দুই দিন আগেও যে ভবনটিতে ছিল মানুষের কোলাহল ও কর্ম তৎপরতা, দুঃস্বপ্নের আগুন সেই ভবনটির সব কিছু স্তব্ধ করে দিলো। গত বৃহস্পতিবার আগুনে প্রাণ গেল ২৫ জনের। আগুনে অথবা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন অন্তত ৭৫ জন।

সর্বনাশা দুর্ঘটনার পর এফ আর টাওয়ারে গতকাল শুক্রবার দিনভর চলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তল্লাশি কার্যক্রম। তবে বৃহস্পতিবার রাতের পর ওই ভবনে আর কোনো লাশ বা জীবিত কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। গতকাল সন্ধ্যার পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা ভবনে তল্লাশি ও উদ্ধার কার্যক্রম সম্পন্ন করে পুলিশের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এর আগে বিকেল ৫টার পরে ভবনে অবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য।

আগুনে যারা নিহত হয়েছেন : অগ্নিকাণ্ডে যে ২৫ জন নিহত হয়েছেন তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলের কাছে স্থাপিত পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দুপুরে এই তালিকা দেয়া হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, এটাই চূড়ান্ত তালিকা। এর বাইরে আর কেউ নিখোঁজ নেই। ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি মুশতাক হোসেন জানান, নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৫ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন ৭৩ জন।

নিহতরা হলেন- সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), মনির হোসেন সরদার (৫২), মো: মাকসুদুর রহমান (৩২), আবদুল্লাহ আল মামুন (৪০), মো: মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), মো: মিজানুর রহমান, ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), আতাউর রহমান (৬২), রেজাউল করিম রাজু (৪০), আহম্মদ জাফর (৫৯), জেবুন্নেছা (৩০), মো: সালাউদ্দীন মিঠু (২৫), নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), তানজিলা মৌলি (২৫), পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক হিরস বিগ্নারাজা (৩৫), মো: ইফতিখার হোসেন মিঠু (৩৭), শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি (২৫), মো ফজলে রাব্বি (৩০), আতিকুর রহমান (৪২), আনজির সিদ্দিক আবীর (২৭), আবদুল্লাহ আল ফারুক (৬২), রুমকি আক্তার (৩০), মো: মঞ্জুর হাসান (৪৯) ও আমির হোসেন রাব্বি (২৯)।

তিনটি ফ্লোর পুড়ে ছাই : এফ আর টাওয়ারের তিনটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভবনের অষ্টম, নবম ও দশমতলা একেবারে পুড়ে গেছে বলে জানান কর্তব্যরত ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো: শাহজাহান সিকদার। ধারণা করা হচ্ছে ভবনের অষ্টমতলা থেকেই আগুন লাগে।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা জানান, ভবনের বেজমেন্ট পুরোটাই গ্যারেজ। সেখানে এখনো কয়েকটি গাড়ি পার্কিং করা আছে। এখানে আগুন লাগেনি। প্রথমতলা থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত তেমন ক্ষতি হয়নি। সপ্তমতলায় আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এই তলাগুলোয় অবস্থিত বিভিন্ন অফিসের কর্মীরা সিঁড়ি দিয়েই নিচে নেমে এসেছেন। ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী বলেন, সিঁড়িতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছিল। এই ফ্লোরগুলোতে সেভাবে আগুন না লাগলেও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সিঁড়ি রুম থেকে ধোঁয়া নিচের ফ্লোরে ঢুকে পড়ে। তবে আটতলার নিচের ফ্লোরের লোকজন নাকে কাপড় চেপে ধরে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

এ দিকে যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই অষ্টমতলায় রেস্টুরেন্ট ছিল বলা হলেও আসলে নেই। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অফিস। প্রতিটি ফ্লোরেই প্রচুর কম্পিউটার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রয়েছে। এগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এফ আর টাওয়ার
উদ্ধারকাজ ও তল্লাশি শেষ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের কাছে এফ আর টাওয়ারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। বিকেলে ভবনটি বনানী থানা পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এরপর ভবনটিতে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের পুলিশ পাহারায় ভেতরে নেয়া হয়।

ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি মোশতাক আহমেদ বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দেখে এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র, কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন। আমরা সেগুলোর তালিকা করে রেখেছি। ভবনটির দুই পাশের ফটকেই পুলিশের পাহারা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার শাহজাহান সিকদার বলেন, আমরা প্রতিটি ফ্লোরে তল্লাশি করেছি। প্রতিটি জায়গা তল্লাশি করা হয়েছে। ভেতরে আর জীবিত অথবা মৃত কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, আমরা কাজ শেষ করেছি। তারপরও এখানে একাধিক ইউনিট অবস্থান করছে।

দুর্ঘটনা ঘটলে নিরাপত্তার দায় ভবন মালিকের
এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব ভবন মালিককে নিতে হবে। গতকাল এফ আর টাওয়ার পরিদর্শনে এসে মেয়র এসব কথা বলেন।

মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কাজে সমন্বয় নেই। এ সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এখন থেকে আমরা অ্যাকশনে নামব। আতিকুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন বহুতল ভবনের আনুষঙ্গিক কাগজপত্র রাজউকের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে সব ভবনকে কাগজপত্র দিতে হবে। এসব হাতে পেলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান শুরু করবে। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, অফিসগুলোকে জানতে হবে তারা যেখানে অফিস নিচ্ছে সেখানে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে কি না। এখন থেকে নিজের নিরাপত্তা নিজেরা বিবেচনা করে দেখবেন। অফিসে ঢোকার আগে দেখে নিন, আগুন লাগলে বের হওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না।

রাজউক এত দিন কী করেছে
পুলিশের আইজি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, গত ১৪ বছরে রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কী করেছে? তিনি বলেন, ভবনটি ১৮ তলা হওয়ার কথা। অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর আছে। তাহলে রাজউক এত দিন কী করেছে। গতকাল এফ আর টাওয়ারের কাছে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পুলিশ প্রধান এ কথা বলেন।

আইজিপি বলেন, প্রাথমিকভাবে ভবনের ব্যাপারগুলো দেখার কথা রাজউকের। সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ভবনটি ১৮ তলা থেকে ২৩ তলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের পরিকল্পনায় ১৮ তলা রয়েছে। ২০০৫ সালে রাজউক জানতে পারে ভবনটি ২৩ তলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময় রাজউক কী করেছে? এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না জানতে চাইলে জবাবে আইজিপি বলেন, এ ঘটনায় মামলা হবে। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা বাদি হলে ভালো হয়। তারা রাজি না হলে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে। ভবন মালিকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ভবন মালিককে শনাক্ত করতে পেরেছেন। এখনো যোগাযোগ হয়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/399118