চাটমোহর উপজেলার অমৃত কুণ্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের লাইনে ছাগল।
৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১২:০৩

দেশপ্রেমের চশমা

নির্বাচনী দুর্নীতি সংক্রামক সমাজব্যাধি

শারীরিক ব্যাধির সঙ্গে সমাজব্যাধির পার্থক্য আছে। শারীরিক ব্যাধি থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা গেলেও সমাজব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করতে বেশি সময় লাগে। যেমন টিউমার একটি শারীরিক ব্যাধি। অপারেশন করে দ্রুত এ ব্যাধি নিরাময় করা যায়। জ্বর একটি শারীরিক ব্যাধি।

প্যারাসিটামল খেলে জ্বর সারতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু নিরক্ষরতা একটি সমাজব্যাধি। যৌতুক একটি সমাজব্যাধি। বাল্যবিয়ে একটি সমাজব্যাধি। এসব ব্যাধি রাতারাতি নিরাময় করা যায় না। একইভাবে ‘নির্বাচনী দুর্নীতি’ একটি সমাজব্যাধি।

এ ব্যাধি থেকেও রাতারাতি আরোগ্য লাভ সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন সমাজব্যাধির সঙ্গে ‘নির্বাচনী দুর্নীতি’ নামক সমাজব্যাধিটির পার্থক্য আছে। এ ব্যাধিটি সাধারণ সমাজব্যাধি নয়। এটি সংক্রামক সমাজব্যাধি। শারীরিক ব্যাধির মধ্যেও সংক্রামক ব্যাধি আছে। যেমন- হাম, আই ভাইরাস প্রভৃতি। এ ব্যাধিগুলোয় কেউ আক্রান্ত হলে তা দ্রুত অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

একবার একজনের চোখ লাল হলে তা সবার চোখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনী দুর্নীতিও অনেকটা তেমন। একটি নির্বাচনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সে দুর্নীতি অন্যান্য নির্বাচনে সংক্রামিত হয়। একটি সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতি যদি দৃশ্যমানভাবে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়ে দুর্নীতিকারীদের কঠোর শাস্তি না দেয়া হয়, তাহলে তা আই ভাইরাসের মতো অন্যান্য নির্বাচনে সংক্রামিত হতে থাকে।

অতীতে না গিয়ে আমরা সাম্প্রতিক উদাহরণ বিবেচনায় নিতে পারি। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হল সংসদ নির্বাচন। আমরা দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন দুটি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।

স্বচ্ছতার পরিমাপকে এ দুটি নির্বাচন একেবারেই ভালো হয়নি। দশম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল তো ভোট অনুষ্ঠানের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৩ আসনে ‘অটো এমপি’ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ওই নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের আগ্রহের মৃত্যু ঘটায়।

আর একাদশ নির্বাচনটি দলীয় সরকারাধীনে অংশগ্রহণমূলক হলেও ভোট হয়ে যায় নির্ধারিত ৩০ ডিসেম্বরের আগে ২৯ ডিসেম্বর রাতে। পরে আবার ভোটের দিন বহুসংখ্যক ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় নির্বাচনী এজেন্টদের বিতাড়িত করে ব্যালট কেটে সিল মেরে বাক্স ভরা হয়। ফলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ভোট ও আসনপ্রাপ্তির ব্যবধান হয় অবিশ্বাস্য। ইসি এ দুটি সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতি-কারচুপির বিচার করেনি। পরিবর্তে, নির্বাচনগুলোকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বীকৃতি দিয়েছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর পিঠা উৎসব করে ইসি সরকারদলীয় প্রশংসা অর্জন করেছে। অন্যদিকে, ইসির একজন সম্মানিত সদস্য মার্জিত ভাষায় এ নির্বাচনের সমালোচনা করে ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন কৌলীন্য হারিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন। অবশ্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭৪ জন প্রার্থী নির্বাচনী ফলাফল বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন।

মামলাকারীরা তাদের আবেদনে বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের আগের রাতে সিলমারা ব্যালট ঢুকিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, বিএনপির পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদানসহ গুরুতর অভিযোগ আনেন।

নির্বাচনের পর বাম জোট ও ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত গণশুনানিতে জোটদ্বয়ের প্রার্থী কর্তৃক নির্বাচনী দুর্নীতির আশঙ্কাজনক বিবরণ উপস্থাপিত হয়। সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতির এই সংক্রামক ভাইরাস এখন অন্য নির্বাচনগুলোতে সংক্রামিত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী ডিএনসিসি, উপজেলা এবং ডাকসুতে নির্বাচনী দুর্নীতির ভাইরাসের সংক্রমণ সুস্পষ্ট, যা নিম্নে তুলে ধরা হবে-

ডিএনসিসি উপনির্বাচন : একাদশ সংসদ নির্বাচনের দুর্নীতির ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ঘটে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)-এর উপনির্বাচনে। বিরোধী জোট বর্জন করায় নির্বাচনটি ভোটারদের আগ্রহ হারায়। যে নির্বাচনে জনগণ আগেই ফলাফল জানতে পারে, সে নির্বাচনে তাদের আগ্রহ থাকে না। সে কারণে এ নির্বাচনে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রমুখী হননি।

ডিএনসিসি নির্বাচনের অনেক কেন্দ্রে ১ ভাগেরও কম ভোট পড়ে, যদিও রাজধানীর ভোটারদের মধ্যে শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় এবং নির্বাচনটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ায় এখানে ভোট পড়ার কথা ছিল অনেক বেশি।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী একজন ইসি কমিশনার এবং সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে সরকারদলীয় প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট দেখতে পাননি। অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় নির্বাচনে উত্তাপ ছিল না। এ নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ৩টি ভোট পড়ে, যা ছিল ওই কেন্দ্রের মোট ২ হাজার ৫০৪ ভোটের মাত্র ০.১২ শতাংশ। আবার ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়া কয়েকটি কেন্দ্রও ছিল।

নির্বাচনী বিশ্লেষকরা ভোটের এহেন অপ্রত্যাশিত ব্যবধানকে অস্বাভাবিক বলে বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের মতে, কিছুসংখ্যক কেন্দ্রে উচ্চহারে ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। এ ভোট তৈরিকৃত (ম্যানুফ্যাকচারড)। সরকারদলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরাই এমন উচ্চ ভোট পান। ডিএনসিসিতে নির্বাচনী দুর্নীতির সংক্রমণ হওয়ায় সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী যেখানে প্রায় সাড়ে আট লাখ ভোট পান, সেখানে বাকি চার প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীদের সবাই জামানত হারান।

এত কিছুর পরও ইসির হিসাবে ৩১ শতাংশ ভোট কাস্ট দেখানো হয়, যেখানে গত বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনগুলোতেও ভোট পড়েছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুর রহিম ৪ মার্চ, সংবাদ সম্মেলন করে ডিএনসিসি নির্বাচনে ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি বলে দাবি করেন।

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ভোটারশূন্য ভোটকেন্দ্রের ছবি এবং নিরুত্তাপ নির্বাচনী পরিবেশ বিবেচনায় নিলে এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তবে এ নির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়াকে বিশ্বাস করা যায় না। নির্বাচনী দুর্নীতির সংক্রামক ব্যাধিই নির্বাচনের কাস্টিং রেটে প্রতিফলিত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচন : মার্চ মাসে শুরু হয়েছে ৫ পর্বের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এর প্রথম তিন পর্ব দেখে অনুধাবন করা গেছে, বিরোধী দলের বয়কটের কারণে নিরুত্তাপ নির্বাচনটিতে দুর্নীতির ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

ভোটারদের মাঝে এ নির্বাচন কোনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে কতিপয় উপজেলায় সরকারদলীয় প্রার্থীর সঙ্গে একইদলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হয়েছে। এসব কারণে প্রথম পর্বে ৮৭ উপজেলায় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও নির্বাচন হয়েছে ৭৮ উপজেলায় এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে একই ধারা বজায় থেকেছে।

প্রথম তিন ধাপে আওয়ামী লীগের ৭১ জন মেয়রপ্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনের মতো এ নিরুত্তাপ নির্বাচনেও ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একতরফা এ নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি ভোটকক্ষে সরকারদলীয় প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট দেখা যায়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গল্পগুজব করে অলস সময় পার করতে দেখা গেছে। দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনেও ছিল একই চিত্র। ফটিকছড়ি উপজেলায় দুটি ভোটকেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৫ হাজার ৩৬০ হলেও ৫ ঘণ্টায় ভোট পড়েনি একটিও (মানবজমিন, ১৮.০৩.২০১৯)।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচনী কর্মকর্তারা গল্পগুজব করে সময় কাটান। পতনউষার উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সোয়া ঘণ্টায় ভোট পড়ে ৭টি এবং শ্রীমঙ্গলের একটি ভোটকেন্দ্রে দেড় ঘণ্টায় পড়ে ৬টি ভোট। খাগড়াছড়ির কতিপয় ভোটকেন্দ্রে ভোটার চোখে না পড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখে পড়ে। ভোটারশূন্য আলাউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯টি বুথের মধ্যে ২টি বুথে একটিও ভোট পড়েনি বলে জানান প্রিসাইডিং অফিসার নিলাদ্রি শেখর দাস।

ওই ৯টি বুথের ২ হাজার ৯৯৭ ভোটের মধ্যে মাত্র ২২ জন ভোটার ভোট দেন। পাবনার চাটমোহর উপজেলার অমৃত কুণ্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের লাইনে কোনো ভোটার না থাকলেও একটি কালো রঙের ছাগল দাঁড়িয়ে ছিল। দ্য ডেইলি স্টার এ ছাগলটির ছবি ছাপে।

তৃতীয় পর্বে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের দুর্ভিক্ষ আরও বাড়ে। এ পর্বে ভোটকেন্দ্রে ছাগল না থাকলেও কক্সবাজারের রুম খাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুটি স্বাস্থ্যবান কুকুরের অলস উপস্থিতি চোখে পড়ে। ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরার ঘটনায় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার ভোট স্থগিত করে এসপি ও ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়।

বেশকিছু কেন্দ্রে গোলাগুলির ঘটনায় আহত হন পুলিশ সদস্য এবং সাধারণ ভোটাররা। ঘটে ভোট বর্জনের ঘটনাও। কাজেই প্রথম তিন পর্বের উপজেলা নির্বাচনের নমুনা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, বাকি দুই পর্বের উপজেলা নির্বাচনেও দুর্নীতি ভাইরাসের একইরকম সংক্রমণ ঘটবে।

ডাকসু নির্বাচন : সংক্রামক ভাইরাসের ধর্ম একটাই। সে যাকে পাবে তাকেই আক্রমণ করবে। একই পথ অনুসরণ করে নির্বাচনী দুর্নীতির সংক্রামক ভাইরাসও। সে কারণে এ ভাইরাসও দেখে না যে, এটি কোন নির্বাচন। ডাকসু বলে তাকে দেয় না কোনো বিশেষ সম্মান। এ কারণে ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ১১ মার্চের ডাকসু নির্বাচনও দুর্নীতির ভাইরাসমুক্ত হতে পারেনি।

নাগরিক সমাজ ভেবেছিলেন, অন্যরকম একটি নির্বাচন হবে। ভেবেছিলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন কাকে বলে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী ও সম্মানিত শিক্ষকরা জাতিকে দেখিয়ে দেবেন। কারণ যে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী ও সম্মানিত শিক্ষকরা; সে নির্বাচনে তারা ভালো কিছু আশা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সে আশা গুড়ে বালি। নির্বাচনী দুর্নীতির ভাইরাস সংক্রামিত হয়েছে এ নির্বাচনেও।

এখানেও সব প্রার্থী সমান সুযোগ পাননি। হলে হলে ভোটগ্রহণে আবাসিক শিক্ষার্থীদের দিয়ে কৃত্রিম লাইন তৈরি করা হয়েছে। ইসির কাছে হাজারও প্লাস্টিকের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স থাকা সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে স্টিলের অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স; যাতে ওই বাক্সে আগে থেকে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে ভরে রাখলে দেখা না যায়।

অনেক হলে ভোট শুরু হওয়ার আগে ভোটারদের দাবি সত্ত্বেও প্রাধ্যক্ষ ব্যালট বাক্স খুলে দেখাতে গড়িমসি করেন। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন এবং তাদের মুরুব্বি বর্ণদলীয় শিক্ষকরা যে এমন কাজ করবেন, তা কেউ ভাবতেও পারেননি। তাদের আচরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচনী কাজে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এমন সব শিক্ষককে, যারা ক্ষমতাসীন সরকারি দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাজন বর্ণদলীয় পরিচয়ে পরিচিত। কাজেই তারা তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাজন ছাত্র সংগঠনের প্রতি দুর্বলতা দেখানোর সুযোগ পেয়েছেন। তাদের দুর্নীতি এত প্রকট ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি হলের প্রাধ্যক্ষকে বরখাস্ত করতে হয়েছে।

অন্য হলগুলোতেও নির্বাচনী কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ ও অন্য সম্মানিত শিক্ষকদের পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত মাত্রায় নিরপেক্ষ ছিল না। সম্মানিত শিক্ষকদের এ ভূমিকায় জাতি লজ্জা পেয়েছে। দু-একটি হলে ছাত্রীদের কঠোর তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের কারণে প্রাধ্যক্ষ পক্ষপাতিত্ব করতে না পারায় সেখানে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জিততে পারেননি। কিন্তু অন্যত্র তারা নির্বাচনী কারচুপি করে ফল অনুকূলে এনেছে।

সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হল, এ কাজে তাদেরকে সহায়তা করেছেন সমবর্ণদলীয় শিক্ষকরা। এ নির্বাচন দেখে সাবেক ভিপি ও কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সরকারের সময়ও ডাকসু নির্বাচনে এমন কলঙ্ক হয়নি।’ অথচ এহেন নির্বাচনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্বচ্ছতার সনদপত্র দিয়েছেন।

ভিসির বক্তব্যে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা প্রদানকারী সিইসির বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে। একমাত্র সরকারদলীয় জোট ছাড়া ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বাকি পাঁচটি প্যানেল এ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। ডাকসুর এ কলঙ্কের পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে সেখানে যে স্বচ্ছ নির্বাচন হবে, এমনটা আশা করা যায় না।

এ আলোচনায় প্রতীয়মান হয়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচনী দুর্নীতির সংক্রামক ভাইরাস অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে সব নির্বাচনকেই আক্রমণ করছে। এ প্রক্রিয়ায় ডিএনসিসি, উপজেলা ও ডাকসু নির্বাচন এ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি।

আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচনগুলোয় দুর্নীতি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো আরও তীব্রতর হবে। সরকারকে নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারাধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করতে পারলে হয়তো এ অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ করতে পারলে তার প্রভাবে স্থানীয় সরকার ও অন্য নির্বাচনগুলোকে নির্বাচনী দুর্নীতির ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচানো সম্ভব।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/160865