৩০ মার্চ ২০১৯, শনিবার, ১১:৫১

মানবিকতার অনন্য নজির

মানুষ মানুষের জন্য। কোনও মানুষ যখন সংকটে পড়েন, বিপদগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন হন তখন ধর্মাদর্শ এবং পারত্রিক বিশ্বাসবোধের ঊর্ধ্বে উঠে যিনি বা যারা বিপন্নের পাশে দাঁড়ান, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন তাঁরাই প্রকৃত মানুষ। এজন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। বিপন্নকে সহায়তার জন্য সক্ষমরা যখন হাত বাড়িয়ে না দিয়ে উল্টো অসহায়কে আরও বিপদে ফেলতে ভূমিকা রাখেন, তাঁদের অবয়ব মানবাকৃতির হলেও অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন। আচরণ হিংস্র হায়েনার চেয়েও ঘৃণ্য।

যে লোকটি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে ৫০ নিরীহ ও নিরপরাধ মুসল্লিকে হত্যা করেছে সে মানুষপদবাচ্য নয়। পশু। জানোয়ার। বরং তার চাইতেও অধম। নিকৃষ্ট। অন্যথায় জুমার সালাতের জন্য সমবেত নিরীহ নিরপরাধ মুসল্লিদের ওপর ঠাণ্ডা মাথায় কেউ গুলি চালাতে পারে তা ভাবা যায় না। পৃথিবীর তাবত বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাবে, এটাই স্বাভাবিক।

উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার। নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় সময় তখন দুপুর দেড়টা। বাংলাদেশে

সকাল সাড়ে ছ’টা। ক্রাইস্টচার্চ এলাকায় আন নূর ও লিনউড মসজিদে পবিত্র জুমার খুতবা চলছিল। এসময় সম্পূর্ণ নিরীহ, শান্তিপ্রিয় পঞ্চাশ জন মুসল্লিকে নির্মম, নিষ্ঠুর ও নৃশংস কায়দায় সামরিক অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে হত্যা করে ঠাণ্ডা মাথায় ২৮ বছর বয়সী এক অস্ট্রেলীয় খৃস্টান জঙ্গি। সেদিন এ সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, মানবতার দুশমন ও কলঙ্ক এবং চরমপন্থী ঘাতক বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে সৃষ্টি করলো এক ন্যক্কারজনক অধ্যায়। শহীদ হলেন সালাতের জন্য আসা ৫০ জন মুসল্লি। আহত হলেন আরও অনেক। একজন আফগান জীবন দিয়ে রুখে না দাঁড়ালে শহীদের সংখ্যা আরও বেড়ে যেতো। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রবাসী ড. আবদুস সামাদসহ আরও ৫ জন বাংলাদেশী আন নূর মসজিদে সেদিন শাহাদাতবরণ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

এ মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঠিক সাতদিন পর ২২ মার্চ, ২০১৯, শুক্রবার একই স্থানে নিউজিল্যান্ডের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন স্থাপন করেন আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সমবেদনা, মানবিকতা এবং মূল্যবোধের এক অনন্য নজির।

খোলা ময়দানে হাজার হাজার শোকার্ত মুসলিম নরনারীর পবিত্র জুমার সমাবেশে তিনি তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নিয়ে হাজির হলেন। শহীদদের সম্মানে দুই মিনিট নিরবতা পালন করলেন এবং মানবতার অমিয় বাণী শোনালেন। তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ অশ্রু। উদ্ধৃত করলেন পবিত্র হাদিসের বাণী। তিনি বললেন, ‘নিউজিল্যান্ডবাসী আপনাদের মতোই শোকাহত। আমরা সবাই এক পরিবারের।’ বেদনাবিধূর ঘটনা ছাপিয়ে সূর্যালোকের মতো সারা বিশ্বজুড়ে মানুষের মন জয় করে নিলেন এ অসাধারণ নারী। বলা যায়, তিনি সেদিন পরিণত হলেন বিশ্বনেত্রী হিসেবে এবং সৃষ্টি করলেন সাম্প্রতিক কালের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

নিউজিল্যান্ডের রেডিও এবং টেলিভিশনের সকল চ্যানেল থেকে টেলিকাস্ট করা হলো প্রধানমন্ত্রীর শোকঘোষণা, আযান, জুমার খুতবা, ইকামত এবং পুরো খুতবা। সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরাসহ পৃথিবীর আরও কিছু চ্যানেলে তা একযোগে সম্প্রচার করা হলো। তবে বাংলাদেশের রেডিও-টিভি চ্যানেলগুলো এসময় লজ্জার মাথা খেয়ে চুপ মেরে থাকে।

নিউজিল্যান্ডের মহিয়সী গরিয়সী নেত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন শোকাহত পরিবারের নারীদের বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাদের শোক, দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় উজাড় করে সকলকে কাছে টেনে নেন। এ যেন অভাবনীয় এক স্বর্গীয় দৃশ্য। তিনি তাঁর গভীর মানবীয় গুণাবলী ও মূল্যবোধ দ্বারা জয় করে নিলেন সকলের হৃদয়। এসময় মনে হচ্ছিল তিনি যেন বিশ্বের সকল নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের কা-ারী হয়ে আর্বিভূত হয়েছেন। তাই তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই। তবে আন নূর মসজিদের ইমাম খুতবায় প্রধানমন্ত্রী এবং নিউজিল্যান্ডের সকল মানুষকে ধন্যবাদ ও তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

পক্ষান্তরে মুসলিম বিশ্বের বড় বড় নেতাদের ধিক্কার ও ঘৃণা জানানো ব্যতীত ভালোবাসা ও সম্মান জ্ঞাপনের কিছু নেই। তাই তথাকথিত মুসলিম নামধারী ক্ষমতার আসনে জেঁকে বসে থাকা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। তাঁরা পারেননি নিজেদের যেমন ইসলামের রঙে রঞ্জিত করতে, তেমনই শেখেননি প্রকৃত দীনের আলোয় উদ্ভাসিত হতে। তাঁরা পারেন শুধু জোর-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন ও কঠোর পন্থা অবলম্বন করে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে জনগণকে দাবিয়ে রাখতে। তবে আশা করা যায়, এ সকল জালিম রাষ্ট্রনায়ক নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের কাছ থেকে কোনও শিক্ষাগ্রহণ না করলেও কিছুটা লজ্জিত হতেই পারেন। কিন্তু তাঁদের তেমন বোধশক্তি থাকলেতো? উল্লেখ্য, জেসিন্ডা আরডার্ন বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। বছর দুয়েক আগে যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর।

জুমার সালাত আদায়ের জন্য দুই মসজিদে সমবেত মুসল্লিদের মর্মান্তিক শাহাদাতে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী শোকাহত এবং সেখানকার মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় বিশ্বনেতারা সবাই খুশি হয়েছেন এমন নয়। কেউ কেউ প্রকাশ্যে না হলেও তাঁদের আচরণে বৈরি মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। ডেনমার্কের এক কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা নিউজিল্যান্ডের মসজিদে মুসল্লি হত্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে কোপেনহেগেনে পবিত্র কুরআনের কপিতে অগ্নিসংযোগ করেছেন। দেশটির সরকারি পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দিয়েছে। গত ২৩ মার্চ আফ্রিকার মালির দুইটি গ্রামে খৃস্টধর্মের সন্ত্রাসীরা ১৫০ জন ফালানি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুও রয়েছে। ফালানি মুসলিমরা নিরীহ এবং সাধারণ মানুষ বলে রয়টার্স এবং আলজাজিরা টিভি রিপোর্ট করেছে। মালিতে সম্প্রদায়গত বিরোধ থাকলেও সেদিনের নিহতরা কোনও চরমপন্থী বা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।

তাঁরা গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে মনে করছেন, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে মুসল্লি হত্যাকা-ে উৎসাহিত হয়েই মালির সন্ত্রাসীরা এ অপকর্ম করেছে। বৃটেনে এক সঙ্গে ৫টি মসজিদেও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর হয়েছে। ভারতের কাশ্মীরসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের বাড়িঘরে ঢুকে হামলা চালানো হচ্ছে। রাস্তাঘাটে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মুসলিমদের। নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না অমানবিক জুলুম থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ভিডিও চিত্র প্রায়শ ভাইরাল হচ্ছে। চিনেও মুসলিম নাগরিকরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার। ৪০ লাখ মুসলিম চিনের বন্দীশিবিরে দীর্ঘদিন থেকে আটক। তাঁদের সালাত আদায় করতে দেয়া হয় না। জোর করে তাঁদের মুসলিমনাম বদলে ফেলা হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কী নিদারুণ জুলুম চালিয়েছে সেদেশের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধ অস্ত্রধারীরা তা এখন বিশ্বের সবার জানা। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। তাঁরা যাতে দেশে ফিরতে না পারেন মিয়ানমার সরকার তার সব অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি গোলান মালভূমি ইসরাইলের এমন ন্যক্কারজনক স্বীকৃতি দিয়েছে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মুসলিমবিশ্ব জোরালো কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না।

নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় শাহাদতবরণকারী ও আহতদের পরিবারপরিজনসহ মুসলিম কমিউনিটির প্রতি প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নসহ সমস্ত অমুসলিম নাগরিকরা যখন সহানুভূতিশীল তখন টুইটার ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা এর নিন্দা জানাবার ভাষা খুঁজে পাই না। আমরা দুনিয়ার সবরকম অমানবিক কর্মকাণ্ড এবং নির্বিচার মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই। সালাম ও সাধুবাদ জানাই নিউজিল্যান্ডের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নকে।

উল্লেখ্য, জেসিন্ডা আরডার্ন ২০ বছর বয়স থেকেই ধর্মত্যাগী। বিশিষ্ট ডিজে শিল্পী। নিজের ডিজে সিডির দোকানে দাঁড়িয়ে নেচেগেয়ে দর্শকদের মাতিয়েছিলেন তিনি একসময়। তখন জেসিন্ডার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগও ওঠে। তবে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলিমদের পাশে দাঁড়াবার ঘটনায় তাঁর জনপ্রিয়তা এখন সত্যিই তুঙ্গে।

http://www.dailysangram.com/post/370214