২৪ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৮:৪৭

বাড়ছে এসএমই ঋণের সুদ হার

খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোন কাজে আসছে না। উল্টো খেরাপির পরিমাণ বাড়ছেই। আসলে ব্যাংকগুলো বড় ঋণ খেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই বড় ব্যবসায়ীদের ছাড় দিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের চেপে ধরছে দেশের ব্যাংকিং খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বড় ব্যবসায়ীদের ঋণে সুদের হার কমাচ্ছে ব্যাংকগুলো, অথচ একই সময়ে ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণে সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে।

এরইমধ্যে দেশের ২১টি ব্যাংক বড় ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। অথচ বেশিরভাগ ব্যাংকই ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) ঋণে সুদের হার এক থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

জানা গেছে,এসব ঋণ খেলাপিরা বড় ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেরই রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়। অনেকে আবার রাজনৈতিক পরিচয়ে ঋণ নিয়েছে। ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরন না হলেও ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ঋণ দিতে হয়্ আর এসব ঋণই সময়ের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ পরিণত হয়। আর এ কারণেই সরকার চাইলেই এসব ঋণ আদায় করতে পারে না। এর আগেও সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি বলেছিলেন,বড় খেলাপিদের কাছে ব্যাংক আসলেই জিম্মি। আমরা চাইলেই এসব ঋণ আদায় করতে পারি না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২১টি ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদী বড় ঋণে সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ নিলেও এই ব্যাংকগুলোই ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) ঋণের ওপর ১১ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদারোপ করছে।
জানা গেছে,এসএমই ঋণ আদায়ের হার সন্তষ্টজনক। বড় এক জন ব্যবসায়ীই ঋণের টাকা পাঁচ শ এসএমই উদ্যাক্তাকে ঋণ দেয়া যায়। এতে অনেক ছোট ব্যবসায়ী উপকৃত হয়ে থাকে। একই সাথে হাজার হাজার লোকে কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। কিন্তু এসব ঋণের সুদেও হার বেশি। এমনকি এসএমই ঋণ পেলে নানা হয়রানির শিকারও হতে হয় উদ্যোক্তাদের।

ব্যাংকের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিট করার কথা থাকলেও এখনও অধিকাংশ ব্যাংক তা কার্যকর করতে পারেনি। অনেকে আবার অংশিক কার্যকর করেছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই নির্দেশনা না মেনে উল্টো এসএমই ঋণের সুদ হার আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে নতুন উদ্যাক্তারা বিনিয়েগে যেতে পারছে না। এর ফলে বেড়ে যাবে বেকারের পরিমান।

নিয়ত ছিল এসএমই ঋণের সুদ হার কম হওয়ার কথা ছিল। কারণ এতে কম বিনিয়োগে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। জিডিপিতে এসএমইর অবদানও অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও উল্টো পথে হাটছে ব্যাংকগুলো। বড় ঋণের সুদ হার কম তারপরেও বড় ব্যবসায়ীদেও ঋণ পেতে কোন হয়রানি হয় না। আর ছোট ছোট উদ্যাক্তাদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের (মিউচুয়াল ট্রাস্ট) এসএমই গ্রাহক গোলাম কিবরিয়া বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে সাড়ে ১৪ শতাংশ হারে সুদারোপ করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ১ মার্চ থেকে ব্যাংকটি দেড় শতাংশ সুদ হার বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ হারে সুদারোপের বিষয়ে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যাংকের বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছরের ১ মার্চ থেকে ১৬ শতাংশ হারে সুদারোপ করা হয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংক ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংকই এখন সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদি বড় ঋণ বিতরণ করছে। একইভাবে ডজনখানেক বেসরকারি ব্যাংকও সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদি বড় ঋণ বিতরণ করছে। গত জানুয়ারি মাসে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদি বড় ঋণ বিতরণ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকটি স্বল্পমেয়াদি ঋণও সিঙ্গেল ডিজিট সুদে বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারিতে সোনালী, জনতা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সিঙ্গেল ডিজিট সুদে বিতরণ করেছে। তবে এই ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র্রও মাঝারি (এসএমই) ঋণে দুই অংকের সুদ আরোপ করেছে।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের ২১টি ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। এর ফলশ্রুতিতে এরইমধ্যে দেশের ২১টি ব্যাংক ঋণের ওপর সুদ হার এক অংকের ঘরে, তথা শতকরা ৯ ভাগে নামিয়ে এনেছে।
এসএমই ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান বলেন, এখন বড় শিল্পগুলোকে সিঙ্গেল ডিজিটের ঋণ দেওয়া হয়, কিন্তু এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের গুণতে হচ্ছে ডবল ডিজিট সুদ। তার মতে, এসএমই খাত ৪৫ থেকে ৪৮ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। জিডিপিতে এর অবদান ৫২ থেকে ৫৫ শতাংশ। এছাড়া, এই খাত বড় শিল্পগুলোর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ নিশ্চিত করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও বলছেন, বাংলাদেশের মতো ক্রমবিকাশমান অর্থনীতিতে জনগণের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এসএমই খাতের গুরুত্ব অনেক। চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে এবং নারীর ক্ষমতায়নে এ খাতের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত।

জিডিপি ও কর্মসংস্থানে রয়েছে বড় অবদান। গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এসএমই খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। বর্তমানে নারীরা সহজ শর্তে এসএমই ঋণ পাচ্ছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তারা। ২০১৭ সালে যার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৪৬০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও ব্যাংকগুলোর প্রচেষ্টায় এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ ও ঋণের গুণগত মান আগের চেয়ে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ পৌঁছাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে গিয়ে ঋণের মান ও উদ্যোক্তা যাচাই করা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসএমই খাতে মোট ঋণ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যেখানে ২০১৭ সালের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৮ সালে এসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই-এর ওপর পরিচালিত এক জরিপের তথ্য মতে, এসএমই’র সঙ্গে যে ব্যাংকিং লেনদেন হয়েছে, তার বেশির ভাগই বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে, যার পরিমাণ ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮২ শতাংশ, যার মধ্যে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের পরিমাণ ৮৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং জামানতের পরিমাণ ৮৭ দশমিক চার শতাংশ।

http://www.dailysangram.com/post/369605