২৪ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৮:৪৫

গ্যাসের দাম বাড়ানোয় আপত্তি সবমহল থেকে

গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে সবমহল থেকে আপত্তি উঠেছে। বাসা বাড়িতে ব্যবহারকারী একজন গ্রাহক যেমন গ্যসের দাম বৃদ্ধি পায় এমনটা চায় না। তেমনি সবধরনের ব্যবসায়ীমহল থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করা হচ্ছে। রাজনৈতিকমহল থেকেও এর বিরোধিতা চলছে। এমনকি জেলায় জেলায় চলছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে সভা সমাবেশ মানববন্ধন। তবে তার পরও গ্যাসের দাম বাড়লে আগামী অর্থবছরে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে মানুষের। শুনানি শেষের পর ৩ মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে হয় বিইআরসিকে। সেমতে দাম বাড়ানো হলে আগামী জুন থেকে তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা গেছে, গ্যাসের দাম ফের বাড়ানোর পথে সরকার। এ লক্ষ্যে গণশুনানির মাধ্যমে আইনি বাধ্যবাধকতা পালনও করেছে। মুনাফায় থাকা সরকারি কোম্পানিগুলো গ্যাসের গড় দাম বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম গড়ে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা পুননির্ধারণ করতে হবে। ফলে গ্যাসের দাম গড়ে ১০৩ শতাংশ বাড়াতে হবে। আগামী জুন মাস থেকে নতুন মূল্যহার অনুযায়ী গ্রাহকদের গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হতে পারে। ফলে আগামী অর্থবছরে গ্যাসের মূল্য বাবদ ভোক্তাদের ব্যয় বাড়বে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে গ্যাস সরবরাহ করা হবে তিন হাজার ৫৫ কোটি ৭০ লাখ ঘনমিটার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে হবে তিন হাজার ৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ ঘনমিটার। বর্তমান দর সাত টাকা ৩৫ পয়সা হিসাবে আগামী অর্থবছর গ্রাহকদের ব্যয় দাঁড়াত ২৫ হাজার ৫৩৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে প্রস্তাবিত দর ১৪ টাকা ৯২ পয়সা হিসাবে সরবরাহকৃত গ্যাস বাবদ গ্রাহকদের গুণতে হবে ৫১ হাজার ৮৩৮ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে জনগণের ব্যয় বেড়ে যাবে ২৬ হাজার ৩০১ কোটি ২১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) গ্যাস বিতরণকারী ছয়টি কোম্পানির প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের বর্তমান গড় মূল্য সাত টাকা ৩৫ পয়সা। এ মূল্য বাড়িয়ে গড়ে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা নির্ধারণ করতে চায় কোম্পানিগুলো। বর্তমানে গ্যাস বিতরণকারী সব কোম্পানি লাভে রয়েছে। তবে ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেলে তাদের ব্যয় বেড়ে যাবে। সেই যুক্তি দেখিয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে তারা।

পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা রয়েছে। তবে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৩২ কোটি ঘনফুট। আগামী এপ্রিল থেকে আরো ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা রয়েছে। মূলত এলএনজি আমদানি দৈনিক ৫০ কোটি থেকে বেড়ে ১০০ কোটি ঘনফুটে বেড়ে যাওয়ার ব্যয় সামাল দিতেই গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। তবে এই কর্মকর্তা জানান, নতুন এলএনজি আনার সব প্রস্তুতি এখনও সম্পন্ন হয়নি। এমনকি ভাসমান টার্মিনাল থেকে এলএনজি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পাইপলাইনও স্থাপন করা হয়নি। সব মিলিয়ে এই এলএনজি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করতে আগস্ট মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

গত ১১ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিইআরসির গণশুনানিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ শুরু করা হয়েছে। দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে এলএনজি যাচ্ছে গ্রাহকদের কাছে। আগামী এপ্রিলে নতুন করে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। আগামী অর্থবছরে দৈনিক ৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে ধরে গ্যাসের দাম প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি ১০ মার্কিন ডলার দরে দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় সরবরাহ মূল্য পড়বে ১২ টাকা ১৯ পয়সা। এর সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ মার্জিন এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ গ্যাসের নতুন দর প্রস্তাব করা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার এক পরিচালক বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণে গ্যাস আমদানি হচ্ছে তাতে ইতোমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিতরণ কোম্পানিসহ অন্যান্য সিস্টেমকে সচল রাখার জন্য দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। আর দেশের শিল্প উত্পাদন বাড়াতে এলএনজি আমদানির চেয়ে ভালো বিকল্প আপাতত আমাদের হাতে নেই। এ প্রেক্ষাপটে দাম কিছুটা বাড়বে। শিল্পখাতকে এ ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিতে হবে। আর আবাসিকে এলপিজি ও পরিবহনে অটোগ্যাস ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আগামী এপ্রিলে এলএনজি পাইপলাইনে আসবে না, এটি সবাই জানে। যে গ্যাস আসেনি তার ওপর ভিত্তি করে দাম বাড়ানো অযৌক্তিক ও অন্যায়। এছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা অলস পড়ে রয়েছে। সরকার যতদিন অর্থ না দেয় ততদিন সে তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে এলএনজির ব্যয় নির্বাহ করা যায়। দেশের ভেতরে গ্যাস অনুসন্ধান-উৎপাদনে জোর না দিয়ে আমদানির জন্য তত্পর একটি পক্ষ। যার ফলে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা জনগণের কাঁধে চেপে বসছে।

বিইআরসি’র প্রস্তাবনা অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলায় মাসিক বিল ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে হবে এক হাজার ৩৫০ টাকা। জোড়া চুলায় মাসিক বিল ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ৪৪০ টাকা হবে। মিটারযুক্ত আবাসিক সংযোগে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১৬ টাকা ৪১ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। গাড়িতে ব্যবহার করা সিএনজির দাম প্রতি ঘন মিটার ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৬ টাকা ১০ পয়সা এবং সার কারখানায় ব্যবহার করা গ্যাসের দাম ইউনিট প্রতি দুই টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ৪৪ পয়সা করার দাবি করা হয়েছে। শিল্প-কলকারখানায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম সাত টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৪ টাকা পাঁচ পয়সা, বিদ্যুেকন্দ্রের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট তিন টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৭৪ পয়সা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ১৮ টাকা চার পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাবনা দিয়েছে বিতরণ কোম্পানি।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, শুনানি শেষ হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে দাম নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর বিধি রয়েছে। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে কোম্পানিগুলো তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বলে কমিশনও মনে করে। দাম পুননির্ধারণে ও মূল্যায়নে এটিও বিবেচনায় থাকবে।

বিজিএমইএ জানায়, দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাসের মাত্র ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ সরবরাহ হয় শিল্প খাতে। বাংলাদেশের মোট গ্যাস সরবরাহের আনুমানিক ৭-৮ শতাংশ হয় পোশাক খাতে। সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে শিল্পে গ্যাসের মূল্য বর্তমানে প্রতি ঘনফুট ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা ৪ পয়সায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবনা অনুযায়ী শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য ১৩২ শতাংশ বাড়বে। এদিকে বিশ্ববাজারে পোশাকের দাম না বাড়লেও প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ হারে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সময়ে মোট উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গ্যাস পেলেও তা অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত। আবার যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করছি, তার চেয়েও বেশি বিল পরিশোধ করছি। অর্থাৎ গ্যাস ব্যবহার না করেও তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে বাতাসের মূল্য দিচ্ছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ইভিসি মিটার চেয়ে আসছি, যাতে চাপ অনুযায়ী গ্যাসের দাম দিতে পারি। গত দু-তিন বছরেও গ্যাস বিতরণ কোম্পানি আমাদের ইভিসি মিটার দিতে পারেনি।

গ্যাসের দাম বাড়লে পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রায় ৫ শতাংশ বাড়বে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কেননা, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের সমান্তরাল প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এ দুটি খাতেরই সমৃদ্ধি ও বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরকারের কাছে আমাদের তিন সংগঠনের একান্ত অনুরোধ, এমন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না, যাতে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হয়, শ্রমিক কর্মসংস্থান হারায়, সর্বোপরি অর্থনীতি গতিহীন হয়ে পড়ে।

বিকেএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনসুর আহমেদ বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কী করব? গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জন্য তিতাস গ্যাস ও বিইআরসিতে কিছু ঘাপটি মারা লোক আছেন, যারা আমাদের কথা চিন্তা করেন না। তারা একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিতে চান। বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারণেই এমডিজি অর্জন হয়েছে, এখন এসডিজি অর্জনেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

বাংলাদেশ বস্ত্র কারখানা সমিতির (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, যদি গ্যাসের দাম বাড়লে প্রতি কেজি সুতার উৎপাদন খরচ ৭ টাকা ৭২ পয়সা বা ৯ সেন্ট হারে বাড়বে। যেখানে বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের প্রতি কেজি সুতায় ৩০ টাকা করে ভর্তুকি দিতে হয়। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বস্ত্র খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের অর্থনীতিতে একাধিক প্রভাব পড়বে।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সালেক সুফি ভোক্তাদের পক্ষে বলেন, “যে পরিমাণ এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলা হচ্ছে, তা হওয়ার আগেই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনা সম্পূর্ণ বেআইনি।”

সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে জনজীবনে এর কতটুকু প্রভাব পড়তে পারে সেই দিকটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন গবেষণার। যদি মনে হয় দাম বৃদ্ধি করলে সার্বিকভাবে উপকার হবে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এই দাম বৃদ্ধি গ্রাহক পর্যায়ে প্রচ- নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি।

http://www.dailysangram.com/post/369603