২৪ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ৮:৪০

শতফুল ফুটতে দাও

সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ কোথায় আছে

ড. মাহবুব উল্লাহ্

মানুষ সুখী হতে চায়, সুখী থাকতে চায়। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু কিসে সুখ হয়, সেটা বোঝা মুশকিল। অর্থনীতিবিদরা এক ধরনের জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে দেখিয়ে থাকেন সুখ থেকে অধিকতর সুখে পৌঁছানোর পথরেখা।

যে জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে মানুষের মনের এ অবস্থাকে দেখানো হয়, বাংলায় তাকে বলে নিরপেক্ষ রেখা এবং ইংরেজি পরিভাষায় একে বলা হয় Indifference Curve. সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য এই জ্যামিতিক চিত্রে দুটি পণ্য দুই অক্ষে দেখানো হয়।

ধরে নেয়া যাক, পণ্য দুটি হল আপেল ও কমলা। ব্যক্তি ভোক্তা একদিকে সর্বাধিক সংখ্যক আপেল খেয়ে যে তৃপ্তি পায়, অপরদিকে একইভাবে সর্বাধিক সংখ্যক কমলা খেয়ে একই পরিমাণ তৃপ্তি পায়। আবার এ দুই বিন্দুর মাঝখানে থাকে অসীম সংখ্যক বিন্দু।

এসব বিন্দুতে দুটি পণ্যেরই সমাহার থাকে। একটি পণ্য ছেড়ে দেয়ার ফলে পরিতৃপ্তি হ্রাস ঠেকানোর জন্য অন্য পণ্যের পরিমাণ বাড়াতে হয়। এভাবে সব বিন্দুগুলোকে যোগ করলে যে রেখার সৃষ্টি হয় তাকেই বলে নিরপেক্ষ রেখা। অর্থাৎ ভোক্তা এ রেখায় অবস্থিত সব বিন্দুতে সমানভাবে পরিতৃপ্ত।


ভোক্তা সর্বাধিক কয়টি আপেল কিনতে পারবে বা সর্বাধিক কয়টি কমলা কিনতে পারবে তা নির্ভর করে ভোক্তার আর্থিক বাজেট ও পণ্যগুলোর দামের ওপর। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাজেটের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু এ নিরপেক্ষ রেখার কোন বিন্দুতে ভোক্তা সর্বাধিক তৃপ্তি পাবে সেটা নির্ভর করে বাজেট রেখা এবং নিরপেক্ষ রেখার ঢাল কোন বিন্দুতে সমান হয় তার ওপর। এ বিন্দু থেকে যে কোনো বিচ্যুতি ভোক্তার তৃপ্তির স্তরকে কমিয়ে দেবে।

ভোক্তা যদি বেশি আয় করতে পারে এবং পণ্যের দামে যদি কোনো তারতম্য না হয় তাহলে তার পক্ষে উচ্চতর নিরপেক্ষ রেখায় যাওয়া সম্ভব হয়। এছাড়া একটি পণ্যের দাম কমে গেলে সেই পণ্যটি বেশি করে কেনা সম্ভব হয়। এর ফলে দু’ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। এর একটি হল আয় প্রভাব এবং অন্যটি হল প্রতিস্থাপন প্রভাব। যাই হোক, অর্থনীতি শাস্ত্রের প্রথম বর্ষের পাঠ থেকে এসব খটমটে জিনিস পাঠকের কাছে হাজির করে তার চিন্তা ও বুদ্ধিকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না।

অর্থনীতিবিদরা সুখ (Happiness) শব্দটি ব্যবহার না করে ‘তৃপ্তি’ ব্যবহার করেন। প্রথম দিককার অর্থনীতিবিদরা তৃপ্তি সংখ্যায় পরিমাপযোগ্য বলে ধারণা করতেন। কিন্তু তৃপ্তি বিষয়টি মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। এ মানসিক অবস্থা সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। তবে এটুকু বলা যায়, অধিকতর তৃপ্ত অথবা কম তৃপ্ত। তৃপ্তির এ অবস্থাকে উত্তরোত্তর অধিক বা কম বলে বিবেচনা করা যায়। এটাও গণিত শাস্ত্রে আছে। আধুনিক নিরপেক্ষ রেখার বিশ্লেষণ তুলনামূলক অধিক অথবা কম তৃপ্তির ভিত্তিতেই করা হয়।

সুখ ও তৃপ্তি শব্দ দুটির দ্যোতনা ভিন্ন হলেও এগুলোকে সম্পর্কযুক্ত ভাবা যায়। তৃপ্তি মূলত বস্তুগত অবস্থার ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে সুখ বস্তুগত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নাও হতে পারে। যেমন প্রশ্ন করা যায় কে বেশি সুখী? একজন সংসারত্যাগী জীবনের ভোগবিলাস ছেড়ে যিনি সাধু হয়েছেন তিনি, নাকি যার প্রচুর বিত্তবৈভব আছে তিনিই সুখী। দেখা যাবে বিত্তবৈভব সত্ত্বেও একজন মানুষ খুবই অসুখী হতে পারে। তার নানাবিধ কারণও থাকে। অন্যদিকে সাধু সন্ন্যাসী পুরুষটি কোনো বিত্তবৈভবের প্রত্যাশা করে না। সে জপমালা দিয়ে ঈশ্বরের নাম জপ করেই নিজেকে সুখী মনে করে। কাজেই সুখের একটা বিমূর্ত রূপ আছে।

এ সুখ আসতে পারে পিতৃস্নেহ-মাতৃস্নেহ থেকে, মানুষের ভালোবাসা থেকে, প্রীতি-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে, এমনকি জীবনের বিশেষ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে। সুখ আসতে পারে জ্ঞান সাধনা করে। যিনি সত্যিকারের জ্ঞান সাধক তিন নিজস্ব বৈষয়িক উন্নতির জন্য জ্ঞান সাধনা করেন না। তার জ্ঞান সাধনার লক্ষ্য হল সমাজের কল্যাণ, মানবজাতির কল্যাণ। বাজার অর্থনীতির এ যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকারের নামে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারও দাম নির্ধারণের প্রয়াস চালানো হচ্ছে। অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানের চর্চায় যা অর্জিত হয় তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ হতে পারে না। কারণ বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে তিনি যদি নতুন কিছু যোগ করেছেন বলে ভাবা হয়, তাহলে মনে রাখতে হবে তার পূর্বসূরি লাখো কোটি জ্ঞান সাধক যে জ্ঞানভাণ্ডার রেখে গেছেন তার ফলেই তার পক্ষে নতুন ধরনের কিছু একটা ধরণা ব্যক্ত করার সুযোগ ঘটেছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ ঢাকায় এক সেমিনারে Intellectual Property Rights-এর ধারণাটি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, জ্ঞান মানবজাতির অভিন্ন সম্পদ। এর ওপর কোনো প্রাইস ট্যাগ বসানো যায় না। কারণ যারা সত্যিকারের জ্ঞান সাধক তারা অর্থ বা বিত্তের লোভে জ্ঞান সাধনা করেন না। নিছক সাধনার মধ্যেই তারা আনন্দ বা সুখ খুঁজে পান। যেমন কবি বলেছিলেন, ‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ’। পথ চলাতে নিঃসন্দহে অনেক কষ্ট আছে। তবুও পথ চলতে গিয়ে নতুন সাথীর সঙ্গে পরিচয় হয়, অজানা আশ্রয়দাতার ঘরে ঠাঁই পাওয়া যায়। কিংবা প্রকৃতির নতুন নতুন রূপ আবিষ্কার করা যায়। এ সবের ফলে মনে হয় পথচলার ক্লান্তির চেয়ে আনন্দ ও সুখের ভাগটাই বড়। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে। এদিক থেকে দুঃখ ও সুখ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কেউ যদি জীবনে দুঃখ না পায় তাহলে সুখের মূল্য নির্ধারণ তার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ স্বর্গের চেয়ে মর্ত্যকেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। কারণ মর্ত্যলোকে সুখ ও দুঃখ দুটিই আছে। কিন্তু স্বর্গলোকে কেবল সুখ আর সুখ। সেই সুখ কী করে বোঝা যাবে যদি দুঃখ না থাকে। সে জন্যই কবির দৃষ্টিতে স্বর্গসুখ খুবই একঘেয়ে মনে হয়েছে। এভাবে বিশ্লেষণ করলে সুখ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা করা যায় না। কুৎসিত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী হাতে থাকা একটি পাখি বনের মুক্ত দুটি পাখির চেয়েও শ্রেয়। এ ক্ষেত্রে ভাবা হয় না মুক্ত পাখিদেরও সুখানুভূতি আছে। নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখ কেড়ে নেয়াও পাপ।
এ বছর সুখী দেশের তালিকায় আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনতি হয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (SDSN) প্রকাশিত ওই তালিকায় ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। গত বছর সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। এটা রয়টার্সের খবর।

এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের শীর্ষ সুখী দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ফিনল্যান্ড। সুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে ভারত ও শ্রীলংকা। ২০১৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ মার্চকে ‘বিশ্ব সুখ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে জাতিসংঘ। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের সুখী দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক। প্রতিবছরের মতো বুধবার (২০ মার্চ) এমন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে মাথাপিছু আয়, সামাজিক সহযোগিতা, গড় আয়ু, সামাজিক স্বাধীনতা, উদারতা ও বিশ্বাসের মানদণ্ডগুলোর ভিত্তিতে। এ বছরের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আগে রয়েছে পাকিস্তান (৬৩)। ভুটান (৯৫) এবং নেপালের (১০০) নাম। আর সুখী দেশের তালিকায় শ্রীলংকা ও ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পরে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১৩০তম ও ১৪০তম।

তালিকায় শীর্ষ দশ সুখী দেশ হল- ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। মজার ব্যাপার হল শীর্ষ দশ সুখী দেশের তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেই। আর সবচেয়ে কম সুখী দেশ হিসেবে তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ সুদান (১৫৬তম), সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (১৫৫তম), আফগানিস্তান ১৫৪তম), তানজানিয়া (১৫৩) ও রুয়ান্ডা (১৫২তম)।

পাকিস্তান কী করে এ তালিকায় উপরের দিকে স্থান পেল তা ভাবতে অবাক লাগে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর এবং সেখানে সন্ত্রাসবাদের থাবার মধ্যে মানুষ বসবাস করে। দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আফগানিস্তান, তানজানিয়া ও রুয়ান্ডার অবস্থা বোধগম্য। ভারতের অবস্থাও বোধগম্য। কারণ ভারতে সামাজিক সহযোগিতা, সামাজিক স্বাধীনতা, উদারতা এবং বিশ্বাসে মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। সেদেশে একদিকে বর্ণপ্রথার বৈষম্য ও ভেদাভেদ এবং অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক আগ্রাসী রাজনীতির ছোবল দেশটির সুখ অনেকাংশেই ম্লান করে দিয়েছে। বিষয়টি হল সুখের জন্য একদিকে জীবনযাত্রাকে হতে হয় সুখকর এবং অন্যদিকে সমাজে থাকতে হয় মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, ভালোবাসা এবং প্রীতি। একটি সমাজ সাময়িকভাবে বৈষয়িক দিক থেকে ভালো অর্জন করতে পারে, তবে তার পাশাপাশি যদি সামাজিক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক বিবেচনাবোধের অভাব ঘটে, তাহলে বৈষয়িক উন্নতি হবে খুবই ক্ষণকালের জন্য। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, গড় আয়ুও বাড়ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে বৈষম্য, বিদ্বেষ ও ঘৃণা। এ দেশে গুম হয়ে গেলে অনেকেই ফিরে আসে না। আবার ফিরে এলে গুমের শিকার ব্যক্তিটি বোবা হয়ে যায়। এ দেশে জীবনের নিরাপত্তাতেও ঘাটতি বাড়ছে। অঙ্কের হিসাবে এ মুহূর্তে এর পরিমাণ কত বলা না গেলেও মানুষ এ ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণাই পোষণ করে। আমরা যা বলতে চাই তা অনেক সময় পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বলতে পারি না। এই এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। এমন অবস্থায় কতটুকু সুখী হওয়া যায়?

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ