১০ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ১:১২

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে? রাজধানীর যোগাযোগ- ২

রাজধানীর সড়কে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। কোমলমতি শিশুরা রাস্তায় নেমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও সড়কে এখনো সেই আগের মতো হ য ব র ল অবস্থা বিরাজমান। মূল রাস্তা দখল করে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, সিগন্যাল অমান্য করা, যেখান সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো ও উল্টোপথে বাস চালানো, ফুটপাতের ওপর দিয়ে গণপরিবহন ও মোটরবাইক চালানো, ওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস ব্যবহার না করে হাত উঁচিয়ে সঙ্কেত দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়া, ফুটপাথ দখল করে দোকানপাট বসানোসহ নানা অনিয়ম আগের মতোই পুরোদমে চলছে। ফলে সচেতন মহলের মনে প্রশ্ন, সড়কের এই নৈরাজ্য শেষ হবে কবে, শৃঙ্খলা ফিরে আসবে কবে?

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা নগরীতে ২৭৯টি রুটে ২৪৬টি কোম্পানির বাস চলাচল করে। ঢাকায় রয়েছে প্রায় ৬ হাজার বাস। এগুলো প্রতিদিন ৩০ লাখ যাত্রী পরিবহন করছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি বাস ৫০০ যাত্রী পরিবহন করছে। আর প্রতিদিনই রাস্তায় নতুন নতুন যানবাহন নামছে। সে তুলনায় রাস্তা প্রশস্ত হচ্ছে না। বরং আরো কমছে। ফুটপাথ দখল করে দোকানপাট বসিয়ে কেনাবেচা করলে সে রাস্তা দিয়ে পথচারীদের হাঁটতে কষ্ট হয়। যানবাহন চলাচলেও বাধাগ্রস্ত হয়।

গত কয়েক সপ্তাহের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নগরীর প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে রিকশা-ভ্যান জটলা পাকিয়ে থাকে। হেলমেট পরা মোটরবাইক চালক ও আরোহীর সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু ফুটপাতের ওপর দিয়ে বাইক চালানো এখনো বন্ধ হয়নি। ফিটনেসবিহীন বাস আবারো রাস্তায় ফিরেছে। বিপজ্জনক ওভারটেকিং বন্ধ হয়নি। ইচ্ছেমতো যেখান-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো এখনো চলছে। বেশি যাত্রী পেতে বাসে বাসে রেষারেষি চলছে আগের মতোই। প্রাইভেটকার, মোটরবাইক ও বাসের ড্রাইভার অনেক সময় সিগন্যাল দেখেও না দেখার ভান করে সুযোগ বুঝে টান মারছে। শত শত পথচারী হাত উঁচিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইচ্ছেমতো রাস্তা পার হচ্ছেন। অনেক জায়গায় ওভারব্রিজ থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার অনেকটা সীমিত। এরকম ঘটনা এখন রাজধানীর সড়কে অহরহ চোখে পড়ছে। নিয়ম শৃঙ্খলার কোনো বালাই দেখা যায় না। গাবতলী, গুলিস্তান, আরামবাগ, মতিঝিল ও মোহাম্মদপুরে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো আছে আগের মতোই। সড়কে নৈরাজ্য এখন এক প্রকার নিয়মেই পরিণত হয়েছে!

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট পল্টন। মোড়ের চার পাশেই রিকশার বড় জটলা। একপ্রকার রিকশা স্ট্যান্ডও বলা যেতে পারে। মিরপুর, সাভার, উত্তরা ও মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর প্রায় সব রুটের যানবাহন এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। একই রাস্তা দিয়ে গণপরিবহন, এক্সপ্রেস, রিকশা-কাভার্ড ভ্যান, মোটরবাইক, প্রাইভেটকারসহ সব যানবাহন চলছে। সেখানে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম পাশে ট্রাফিক পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। তিন পাশে সিগন্যাল থাকায় এক পাশ দিয়ে যানবাহন চলছে। কিন্তু হুট করে রিকশাওয়ালা, বাইক চালক কিংবা কার চালক অন্য পাশ থেকে রাস্তার মাঝখানে চলে আসছে। ওই মোড়টিতে ওভার ব্রিজ চোখে পড়েনি। ইচ্ছেমতো পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। কখনো পথচারীদের রিকশার সাথে ধাক্কা লাগছে, কখনো বা মোটরসাইকেল পেছন দিক দিয়ে পথচারীদের ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে।

দেখা গেছে, সড়ক ছেড়ে ফুটপাথের ওপর দিয়ে গণপরিবহন ও মোটরবাইক চলাচল করছে অহরহ। চলাচলেও কোনো শৃঙ্খলা চোখে পড়েনি। যাত্রী উঠানোর জন্য ট্রপিকানা টাওয়ার ও অপর প্রান্তে ব্যাংকের সামনে বাসের ভিড় লেগে যাচ্ছে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখেই ড্রাইভার-হেলপাররা তাদের ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠানো নামানোর কাজ করছেন। ট্রাফিক পুলিশ হাতে থাকা ছোট লাঠি দিয়ে সামনে আগাতে বললেও যাত্রী উঠানোর জন্য ব্যস্ত বাসগুলো। আর পেছন দিক থেকে আরেকটি বাস সামনে যাওয়ার জন্য সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া মিলছে না। সামনের বাস চলে গেলে পেছনের বাসটিও একই কৌশলে যাত্রী উঠানো নামানোর কাজ করছে।

উল্টোপথে গাড়ি চলাচল পল্টনের মতো প্রায় প্রতিটি রাস্তায় চোখে পড়ে। সিগন্যাল থাকলেও হুট করে যানবাহনগুলো ইউটার্ন করছে। আর তখনই জটলা সৃষ্টি হচ্ছে। পল্টন মোড় থেকে একটু দূরে বিজয়নগর পানির ট্যাংক। ট্যাংকির উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটো মোড়। এ দুইটি মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ না থাকলেই যানবাহন চলে ইচ্ছেমতো। উত্তর পাশ দিয়ে শত শত বাস-প্রাইভেটকার আসছে। হুট করে পূর্ব পাশ দিয়ে রিকশাওয়ালা কিংবা প্রাইভেটকার এসে রাস্তা পার হতে যাওয়ায় বড় ধরনের জটলা সৃষ্টি হচ্ছে। পাশে সেগুনবাগিচা কাঁচা বাজারের সামনে রাস্তায় ডিভাইডার দিলেও কেউ মানছেন না। দুই পাশ দিয়েই সমানতালে উল্টোপথে বাইক, প্রাইভেটকার ও রিকশা যাওয়া-আসা করছে। এরকম চিত্র গুলিস্তানসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গিয়েও দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে বুয়েটের এআরআই ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো: সাইফুন নেওয়াজ নয়া দিগন্তকে বলেন, রাস্তার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট হলো প্রতিদিনের একটি পার্ট। এগুলো রেগুলার করতে হয়। সব সময় একই স্ট্যান্ডার্ডে রাখতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখা যায় না। অনেক সময় পরিবেশও থাকে না। বেশির ভাগ সময় ট্রাফিক পুলিশের শৃঙ্খলার কাজে বেশি মনোযোগ দিতে হয়। একই সাথে আইন অমান্য করা, উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে এলে আইনের আওতায় আনা, মামলা দেয়াÑ এসব কাজও করতে হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে এ দুইটি কাজের সমন্বয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। তা ছাড়া যারা রাস্তায় যানবাহন চালান তাদের ও পথচারীদেরও সচেতন হওয়া দরকার। তাহলে রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) কামরুন নেছা নয়া দিগন্তকে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আমরা কাজ করছি। যানবাহন উল্টোপথে গেলে, আইন না মানলে প্রতিদিনই মামলা দেয়া হচ্ছে। কেউ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে গাড়ি ও চালককে শনাক্ত করে মামলা দেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা দিয়ে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সড়কে শৃঙ্খলা আসার জন্য ড্রাইভার, হেলপার, পথচারীসহ এর সাথে জড়িত সবাইকে সচেতন হওয়ার দরকার। মানসিক পরিবর্তন দরকার।

এ প্রসঙ্গে যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রায়ই দেখা যায় বাস হঠাৎ করে রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে। পথচারীরা হুটহাট করে যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পার হন। যেমন পল্টন মোড়ে খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থা। জনসচেতনা ও ব্যক্তির মানসিক পরিবর্তন দরকার। এছাড়া ডিজিটাল সিগন্যাল চালু হলে সড়কে ৫০ ভাগই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/394181