১০ মার্চ ২০১৯, রবিবার, ১:০৪

গ্যাসের দাম বাড়ছে এ মাসেই

এলএনজি আমদানির প্রভাব; কাল থেকে গণশুনানি শুরু; দুর্ভোগ বাড়বে জনজীবনে

বেশি মূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে কম মূল্যে বিক্রি করায় বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকি। এ ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো মূল্য বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির আয়োজন করেছে বিইআরসি। চারদিনব্যাপী এ গণশুনানি শুরু হবে আগামীকাল ১১ মার্চ থেকে। এরপরেই আসবে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা। বিইআরসির দায়িত্বশীল সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে।

কেন এ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : তিতাসের এক সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু মজুদ বাড়ছে না। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় বিদ্যমান মজুদও ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যের জ্বালানি এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে গ্যাসের গড় দাম। বেশি দামে আমদানি করে কম মূল্যে বিক্রি করায় ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। পেট্রোবাংলার সূত্র বলেছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে ছোট্ট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। তারপর আর কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। উদ্যোগও তেমন ছিল না। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিকল্পনা পর্যায়েই আছে।

পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান গ্যাস মজুদ রয়েছে ১২ টিসিএফ। আর প্রতি বছর ব্যবহার হয় ১ টিসিএফ। সে হিসাবে ১২ বছরের গ্যাস মজুদ রয়েছে। মজুদ ফুরিয়ে এলেও গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গত ১০ বছরে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। বরং ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন সময় কিছু কর্মসূচি নেয়া হলেও তা বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এরপর বাপেক্সকে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করানো হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাওয়ার আগেই সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাাম’ ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়। ওই কর্মসূচিও তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।

বর্তমান চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় গ্যাস সঙ্কট চরম আকারে পৌঁছেছে। আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে নতুন শিল্পকারখানায়। এমনি পরিস্থিতিতে সঙ্কট মেটাতে গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৪৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এপ্রিল থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার কথা রয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে দাম নিয়ে। প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে ৩২ টাকা করে। এ পর্যন্ত ৪ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। প্রতি ঘনফুট বিক্রি করা হচ্ছে ৭ টাকা ১৭ পয়সা করে। এতে এ পর্যন্ত সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল থেকে এ ভর্তুকি আরো বেড়ে যাবে। ভর্তুকি কমাতেই গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব : বিভিন্ন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে। বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪৫ কোটি থেকে ৪৭ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিলে এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭০ কোটি ঘনফুটে। বেশি দামে এলএনজি কিনে কম দামে বিক্রির কারণে আর্থিক ঘাটতি তৈরি হবে। এই আর্থিক ঘাটতি এড়াতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রয়োজন। দৈনিক দেশের অভ্যন্তরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২৭১ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট এবং আমদানি করা এলএনজি ৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করার হিসাব ধরে এই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে বলা হয়, গ্রাহক পর্যায়ে এক বার্নারের গ্যাসের চুলা ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা, দুই বার্নারের চুলা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২০০ টাকা এবং মিটারযুক্ত চুলার ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৬৫ পয়সা করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৬ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে ৯ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৭০ পয়সা, সার কারখানার ক্ষেত্রে ২ টাকা ৭১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা, শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৭ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং সিএনজির গ্যাসের দাম ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এদিকে চার মাসের মাথায় পুনরায় গ্যাস সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সঞ্চালন চার্জ ঘনমিটার প্রতি ০.২৬৫৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ০.৪২৩৫ টাকা করেছিল কমিশন।

দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি : বিইআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩ অনুযায়ী জিটিসিএল, তিতাস গ্যাস, বাখরাবাদ গ্যাস, জালালাবাদ গ্যাস, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস, কর্ণফুলী গ্যাস, সুন্দরবন গ্যাস তাদের বিতরণ চার্জ ও ভোক্তা পর্যায়ে দাম পুনর্নির্ধারণের জন্য কমিশনে আবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দিন ১১ মার্চ সোমবার সকাল ১০টায় গ্যাসের দামের ওপর একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। একই দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) প্রস্তাবিত সঞ্চালন চার্জের ওপর শুনানি হবে। পরদিন ১২ মার্চ সকালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রস্তাবিত দামের ওপর শুনানি হবে। দুপুর আড়াইটা থেকে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবের ওপর শুনানি হবে।

১৩ মার্চ সকালে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের আর দুপুরে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের প্রস্তাবের ওপর শুনানি করা হবে।
এছাড়া ১৪ মার্চ সকালে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং দুপুরে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবিত দামের ওপর শুনানি করবে কমিশন।

বাড়বে জনজীবনে দুর্ভোগ : গ্যাসের মূল্য বাড়ার সাথে সাথে জনজীবনের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা, গ্যাসের মূল্য বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে শিল্পের উৎপাদন ব্যয়। আর শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। একদিকে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে জনসাধারণের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে, এর ওপর পণ্যের দাম বেড়ে গেলে জনসাধারণের দুর্ভোগ চরম আকারে বেড়ে যাবে। তাদের মতে, গ্যাস উৎপাদন বাড়লে উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করা হতো না। তারা বলেন, দেশে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরে আসছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার না হলে দেশের জ্বালানি সম্পূর্ণ উচ্চমূল্যের জ্বালানিনির্ভর হয়ে পড়বে। গ্যাসের দাম বহুগুন বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন মূল্য। শিল্পে অচলাবস্থা দেখা দেবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/394186