২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:৩৯

আটকে আছে পুনঃউন্নয়ন প্রকল্প

পুরান ঢাকা বাঁচবে তো

নিমতলী ট্র্যাজেডিসহ পুরান ঢাকায় যখন একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ও ভবনধসের ঘটনা ঘটে চলছিল, এরই প্রেক্ষাপটে আরবান ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট (ভূমি পুনঃউন্নয়ন) পদ্ধতির মাধ্যমে পুরান ঢাকাকে বদলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক দৌড়ঝাঁপও করেছিলেন তারা। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে অনেক মতবিনিময়ও হয়েছে। রাজউক তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, সিঙ্গাপুর-জাপান-কোরিয়াসহ উন্নত অনেক দেশ এভাবেই ঘিঞ্জি এলাকাকে আধুনিকভাবে সজ্জিত করেছে। তার পরও এলাকাবাসীর অনীহা আর রাজউকের দুর্বলচিত্তের কারণে ভেস্তে গেছে পুরান ঢাকার ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কার্যক্রম। ফলে পুরান ঢাকাকে আধুনিকভাবে সজ্জিত করার উদ্যোগও থেমে গেছে। ঘিঞ্জি, সরু রাস্তাঘাট আগের মতোই বিদ্যমান। যে কোনো দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস বা অ্যাম্বুলেন্স চলাচলও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ঘটে চলেছে একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার মাহমুদ বলেন, 'ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের শর্ত হলো, যারা জমির মালিক তাদের মধ্যে একজন আপত্তি করলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। রাজউক পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও তাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। অনেকেই মনে করেছেন, উন্নয়নের দায়িত্ব রাজউকের হাতে ছেড়ে দিলে ওই জমিই হয়তো ভবিষ্যতে ফেরত পাবেন না তারা। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় অনেক জমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা আছে। এসব জমি যাদের দখলে আছে, তারা মনে করেছেন রিডেভেলপমেন্ট হলে দখল ফিরে পাবেন না। এ জন্যই এলাকাবাসী বাধা দিয়েছেন। কিন্তু পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে হলে ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের কোনো বিকল্প নেই, যেভাবে কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ানের অনেক জায়গার পুনঃউন্নয়ন করা হয়েছে।'

বুধবার রাতে চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে হতাহতের ঘটনার পর পুনঃউন্নয়নের এ আলোচনা আবার সামনে এসেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সমকালকে বলেন, 'রাজউক ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের যে আইডিয়া নিয়ে আমার কাছে এসেছিল সেটা খুবই ভালো আইডিয়া। সিঙ্গাপুর ও জাপান এভাবে পরিকল্পিত নগরায়ন ঘটিয়েছে। আমার দায়িত্ব ছিল মধ্যস্থতাকারীর। কিন্তু পুরান ঢাকার হোল্ডিং মালিকদের যখন ডাকলাম তারা অনাগ্রহ দেখাল। কারণ পুরান ঢাকায় ঘরবাড়ি যখন হয়েছে, তখন রাজউক ছিল না। বাংলাদেশও হয়নি। বংশপরম্পরায় তাদের জমির বণ্টননামা নিয়েও ঝামেলা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করেছে এই জমি রাজউককে ডেভেলপের জন্য দিলে তারা ঠিকমতো বুঝিয়ে দেবে কি-না বা যাদের জমি নিয়ে বণ্টননামার জটিলতা রয়েছে তারা ফেরত পাবে কি-না। এমনকি তিন বছর যে ডেভেলপের জন্য লাগবে- এ সময়টা তারা কোথায় থাকবে। অনেকে তো ওই অবকাঠামোর আয়ের ওপরই বেঁচে থাকে। এ রকম নানা জটিলতার জন্য তারা আপত্তি দিয়েছিল। এ জন্য কাজটা করা যায়নি।

জানা যায়, ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ, স্থপতিসহ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পুরান ঢাকাকে আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের উদ্যোগ নেয় রাজউক। প্রাথমিকভাবে বকশীবাজার, চাঁদনীঘাট, চকবাজার, মৌলভীবাজার, পুরাতন জেলখানা এলাকা, ইসলামবাগ, রহমতগঞ্জ ও বাবুবাজার এলাকায় তা বাস্তবায়নের চিন্তা করে। মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালানোর পর ২০১৬ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বংশালের দুটি এলাকাকে রিডেভেলপমেন্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। শুরু হয় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে মতবিনিময়। রাজউক এলাকাবাসীকে রিডেভেলপমেন্টের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করে। অনেকে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করেন। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের মতামত প্রত্যাশা করে রাজউক। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর রাজউক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। মেয়রও এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে সভা করে এলাকাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরে আরমানিটোলায় পুরান ঢাকার বাসিন্দা, স্থানীয় পাঁচটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও রাজউকের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সভা হয়। সভায় কিছু বাসিন্দা রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বিষয়ে রাজউকের ওপর আস্থাহীনতার কথা ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ যেভাবে আছেন, সেভাবেই থাকতে চান। এলাকাবাসীর বেশিরভাগ মতামত রাজউকের বিরুদ্ধে গেলে স্থগিত হয়ে যায় রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের কার্যক্রম।

ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প কী :রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানান, ঘিঞ্জি এলাকার একেকটি এলাকা নিয়ে একটি ব্লক তৈরি করা হয়। সেই ব্লক ধরে পরিকল্পনা করে বহুতল ভবন তৈরি হয়। এসব ভবনে থাকবে আধুনিক নাগরিক সুবিধা। বর্তমানে পুরান ঢাকার ভবনগুলোর উচ্চতা কম। তলার সংখ্যা বাড়িয়ে পাশের জায়গা উন্মুক্ত করে দিয়ে প্রথমে সে জায়গায় প্রশস্ত সড়ক তৈরি করা হবে। পাশাপাশি তৈরি করা হবে উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি। তবে বড় ধরনের কোনো অবকাঠামো কোনো ব্লকের মধ্যে পড়ে গেলে, সেটাকে ধরেও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। প্রকল্প এলাকার বসতিদের তিন বছরের জন্য বাইরে থাকতে হবে। এ সময়ের মধ্যে রাজউক নিজ অর্থায়নে এলাকাকে আধুনিক করে দেবে। এ জন্য জমির মালিকের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। রিডেভেলপমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো ছোট প্লটগুলোকে একীভূত করে একেকটি এলাকার আধুনিকায়ন হবে। প্রতিটি ভবন হবে ২০ তলা। রাস্তা ও উন্মুক্ত স্থানের জন্য জায়গা ছেড়ে দিলেও উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আগের তুলনায় বেশি ফ্লোর স্পেস পাবেন জমির মালিক। আর জমির অনুপাতে ফ্লোর ভাগাভাগি হবে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের প্রশস্ততা হবে ৫০ ফুট। বাকি সড়কগুলোর প্রশস্ততা হবে ৩০ ফুট। এ ছাড়া থাকবে খেলার মাঠ, হাসপাতাল, জিমনেসিয়াম, পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার, উন্মুক্ত স্থান প্রভৃতি। এভাবে ২০ বছরের মধ্যে পুরো এলাকাকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলবে রাজউক।

ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়নি। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি। ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট করলে রাস্তাও প্রশস্ত হতো, আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যেত। অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড়াতে পারত। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কারণে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। অথচ রিডেভেলপমেন্ট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'পুরো সিঙ্গাপুর আজ আধুনিক শহর হয়েছে ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুম্বাই ও কলকাতায়ও এখন এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। কলকাতার মতো বেসরকারি ডেভেলপারদেরও এ কাজে যুক্ত করা যেতে পারে।' তিনি জানান, হাজারীবাগে নতুন করে ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর বংশালের কিছু লোক রাজউককে অনুরোধ করছে এটা বাস্তবায়নের জন্য। আইন প্রণয়ন করে হলেও এটা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন বলে মত দেন আশরাফুল ইসলাম।

রিডেভেলপমেন্ট কার্যক্রম বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা ও ঢাকা ওয়াসার সাবেক উপসচিব আজফার-উজ-জামান সোহরাব বলেন, 'রাজউকের রিডেভেলপমেন্ট ফর্মুলা অবশ্যই ভালো। পুরান ঢাকার জন্য এ ফর্মুলাই দরকার; কিন্তু রাজউকের ওপর জনগণের আস্থা নেই। এ জন্যই এলাকাবাসী আপত্তি জানিয়েছে।'

রাজউক জানায়, জমি মালিকদের মধ্যে যাতে আস্থা তৈরি হয়, এ জন্য ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের খসড়া বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে। বিধিমালায় অ্যাডভাইজার প্যানেল, ব্যবস্থাপনা কমিটি, জমির মূল্যায়ন কমিটি, ভূমির পুনঃউন্নয়নের ধাপগুলো উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া জমি মালিকদের সঙ্গে চুক্তিপত্র এবং প্রকল্প সম্পন্নেম্নর পর ব্যবস্থাপনাসহ সবই বিস্তারিত যুক্ত করা হয়েছিল। কমিটিগুলোতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের রাখার কথা বলা ছিল। কিন্তু যেসব জমির মালিকের দুর্বলতা আছে, তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে পড়েন।

নগরবিদরা জানান, ঢাকার গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট ছিল সরু। সময়ের পরিক্রমায় সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট প্রভৃতি। বর্তমানে প্রতি একর জমিতে গড়ে ৬০০ মানুষের বাস। একদিকে সরু রাস্তাঘাট ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের কারণে স্বাভাবিক চলাচলও কঠিন। এ ছাড়া পুরান ঢাকার একটি পৃথক সংস্কৃতি রয়েছে। সেই সংস্কৃতি থেকে বেরোতেও পুরান ঢাকাবাসীর অনীহা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, 'পুরান ঢাকার যে অবকাঠামোগত অবস্থা তাতে প্রতিদিনই এ রকম ট্র্যাজেডি ঘটার কথা। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে প্রতিদিন ঘটে না। আসলে পুরান ঢাকার ভবনগুলো ব্যবহারের একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। সেই নীতিমালা না থাকার কারণে মিশ্র ব্যবহারের নাম দিয়ে একই ভবন কারখানা, দোকানপাট, আবাসিক খাতে ব্যবহার করা হয়।' তিনি মনে করেন, এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক আকারে রিডেভেলপমেন্ট করাটা বেশ কঠিন। মধ্যম পর্যায়ের রিডেভেলপমেন্ট করেও পুরান ঢাকাকে প্রস্তুত করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যকে ধারণ করে ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে আধুনিকভাবে সাজাতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, 'ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট ফর্মুলা অত্যন্ত ইতিবাচক। এ ফর্মুলা প্রয়োগ করে বিশ্বের অনেক ঘিঞ্জি শহর ভেঙে আধুনিক শহরে পরিণত হয়েছে। তবে এ কাজ করতে গেলে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। জনগণ এগিয়ে এলে অনেক সহজেই এ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা যায়।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট ফর্মুলার মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক ঘিঞ্জি শহরকে আধুনিক ও বাসযোগ্য শহরে রূপান্তর করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।'

https://samakal.com/capital/article/19021688