২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:২৫

অতি মুনাফার লোভই চকবাজার ট্র্যাজেডি

মৃত্যুপুরীতে বসবাস!

পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত বাড়িঘর, লাগালাগি ভবন ও ঘিঞ্জিগলি মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।

এর মধ্যে ক্ষতিকর দাহ্য পদার্থের গুদাম, রাসায়নিক পণ্যের মজুদ এবং বিভিন্ন কারখানা মানুষের বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। ঘটছে ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা।

বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এ সব ঘটনা মনে করিয়ে দেয় পুরান ঢাকা কতটা বিপজ্জনক!

নিমতলীর বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা, ইসলামবাগ, লালবাগের এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে খোঁজ করলে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা বা গুদাম পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আবাসিক ভবনের নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন ও জুতার কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া নানা ধরনের অবৈধ পণ্য তৈরির কারখানাও রয়েছে। এসব কারখানার আশপাশের মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।

ঝুঁকি জেনেও কেন এমন কারখানা ভাড়া দেয়া হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলামবাগের বাসিন্দা কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ধরেন, আমি একজন বাড়িওয়ালা। আমার আয় কম। আপনি আমাকে ৫-৬ লাখ টাকা আগাম দিয়ে দিলেন, আর আমিও টাকার লোভে আপনাকে ভাড়া দিয়ে দিলাম। দোতলায় আমি বাড়িওয়ালা থাকছি ফ্যামিলি নিয়ে। পাশের ফ্ল্যাটে একটি জুতার কারখানা আর নিচে জুতা তৈরির জন্য আঠার গুদাম। এটা এমনই ঝুঁকিপূর্ণ যে একটি সিগারেট ধরিয়ে দিলে আগুন লেগে যাবে। তিনি দাবি করেন, পুরান ঢাকার সর্বত্র এমন পরিবেশ। চকবাজারের চুড়িহাট্টার যে ভবনে আগুন লাগে, তার পাশের একটি কারখানায় কাজ করেন আশরাফ ও মোনায়েম। তারা বলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে বুঝি, কিন্তু কী করব পেটের দায়ে কাজ করি। তারা জানান, এ এলাকায় অবৈধ কারখানা বেশি। শুধু এসব এলাকায়ই নয়, লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর ও কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অবৈধ হাজার হাজার কারখানা ও দাহ্য পদার্থের গুদাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকার অবৈধ কারখানার মধ্যে রয়েছে- ব্যাটারি তৈরি, নকল ওষুধ, নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল, ঝালাই, খেলনা ও জুতা-স্যান্ডেলসহ শতাধিক ধরনের পণ্য তৈরির কয়েক হাজার কারখানা। বিভিন্ন জায়গায় এসব পণ্য উৎপাদনে দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে জুতা তৈরির কারখানায় যে সল্যুশন ব্যবহার করা হয়, সেগুলো খুবই বিপজ্জনক।

নিমতলী থেকে লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, এসব এলাকার বাসাবাড়িতে এখনও এ ধরনের রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ মজুদ রাখা হচ্ছে। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর এসব এলাকার অবৈধ কারখানা ও গুদাম তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। দুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি জানেন ব্যবসায়ীরাও। চকবাজারের বাসিন্দা আতাহার হোসেন বলেন, গণহারে এখানে কেমিক্যালের গোডাউন গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালির কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক কারখানা মালিক জানান, বংশপরম্পরায় তারা এসব ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। এ ব্যবসার ওপরই তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে।

নবাব কাটরার বাসিন্দা সলিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগে সব শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, চোরের ভয়ে প্রতিটি বাড়িতে এমনভাবে গ্রিল দেয়া হয়েছে যে, আগুন লাগলে তা ভেঙে বের হওয়ার সুযোগ নেই। এগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর আগুনের লেলিহান শিখা এখনও ভুলতে পারেনি এলাকার মানুষ। সেই ধ্বংসযজ্ঞ, লাশের মিছিল মন থেকে সরেনি। সেই আতঙ্ক এখনও তাড়া করে ফেরে আমাদের। সত্যি আতঙ্কের মধ্যেই বসবাস এ এলাকার মানুষের। ক্ষোভ প্রকাশ করে এলাকার অনেকে বলেন, ঘিঞ্জি অলিগলি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা বা শিল্পকারখানা কতটা বিপজ্জনক, প্রায় নয় বছর আগে তা দেখেছে মানুষ। কিন্তু শিক্ষা হয়নি।

এদিকে, একের পর এক প্রাণহানির ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছেন পুরান ঢাকার মানুষ। শুক্রবার বিকালে চকবাজারে মানববন্ধন করে স্থানীয় ছাত্রলীগ। এলাকা থেকে অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা, গুদামসহ সব অবৈধ কারখানা অপসারণ ও আবাসিক ভবন থেকে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও দাবি জানান তারা।

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ মঞ্জিল বেসমেন্টে শত শত কনটেইনার ও বস্তায় এখনও মজুদ রয়েছে রাসায়নিক পদার্থ। এ বেসমেন্টে আগুন পৌঁছলে বিস্ফোরণের মাত্রা অকল্পনীয় ভয়াবহ হতো। শুক্রবার ওয়াহেদ মঞ্জিলের বেসমেন্টে দেখা মেলে শত শত ড্রাম, বিভিন্ন কনটেইনার ও প্যাকেটে নানা ধরনের কেমিক্যাল। এসব কেমিক্যাল, পাউডার এবং লিকুইড। কেমিক্যালে ভরপুর পুরো বেসমেন্ট। ফায়ার সার্ভিস জানায়, এসব পাউডার উচ্চ দাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। এ ভবনটিতে শুধু অননুমোদিতভাবে রাসায়নিক মজুদ করা হয়েছে তাই নয়, মজুদ করার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনও মানা হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, এ এলাকাগুলো সার্ভে করে ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থের কারখানা সরানোর কথা বলেছিলাম। এখন তারা গোপনে ব্যবসা করলে তো আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কিছু করার নেই। সিটি কর্পোরেশনকে সরানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এখন সময় এসেছে পদক্ষেপ নেয়ার। না হলে আরও বড় ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এসএম জুলফিকার রহমান বলেন, ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু ওই এলাকার রাস্তাগুলো সরু হওয়ায় তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। পর্যাপ্ত পানিও পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক হিসাবে দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম আছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদাম অবৈধ। বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে এ দুর্ঘটনা। ২০১০ সালের নিমতলীর ঘটনার পর দাহ্য পদার্থের গুদাম আলাদা জায়গায় সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কেমিক্যাল পল্লীর কথাও শুনেছিলাম। এরপর ভেতরে ভেতরে কী হল আমরা জানি না। ব্যবসায়ী মহলকে সহাযোগিতা করতে হবে। জীবনের বিনিময়ে ব্যবসা করা ভালো না। এতগুলো মানুষ নিহতের ঘটনায় দায় তাদেরও আছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, নির্লিপ্ততা আমাদের এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে যে, আমরা এখন দোষারোপ করার কাউকে পাচ্ছি না। কর্তৃপক্ষের সীমাহীন অবহেলা আর কিছু মুনাফা লোভীদের লালসার কারণেই মৃত্যুর মিছিল কমছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু কাগজে-কলমে পরিকল্পনা নয়, প্রয়োজন বাস্তবায়ন করা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার আরমানিটোলা, চাঁদনীচক, নিমতলী, নাজিমউদ্দিন রোড, সুরিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, লালবাগসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে চার শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। কেমিক্যাল রাখার কারণে এসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। আবার নির্মাণ ত্রুটি ও মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণেও পুরান ঢাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ভবনের কোনো অন্ত নেই।

স্থানীয় লোকজন জানান, এলাকায় ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ইচ্ছে করলেই আসতে পারে না। দিনের বেলা তো আরও বেশি জটিলতা। সব সড়কে গাড়ি আর মানুষের জটলা থাকে। এখানে নিরাপদ বাসস্থান নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে কেউ ভাবে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/147447