২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:৫৬

ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে শত শত কনটেইনার কেমিক্যাল!

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তবে ভবনের বেজমেন্ট এখনো অক্ষত রয়েছে। ওই বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে ঢুকতেই মেলে বিশাল কেমিক্যালের গোডাউন। ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে শত শত কনটেইনার ও বস্তায় বেআইনিভাবে এখনো মজুদ আছে রাসায়নিক। আগুন বেজমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছলে বিস্ফোরণের মাত্রা হতো অকল্পনীয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, বেজমেন্ট পর্যন্ত আগুন পৌঁছলে বিস্ফোরণের মাত্রা হতো ব্যাপক। এতে আগুন নেভাতে সময় লাগত অনেক বেশি। ফলে বেড়ে যেত হতাহতের সংখ্যাও। অথচ গত বৃহস্পতিবার শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে ওয়াহেদ ম্যানশনে কোনো কেমিক্যালের গোডাউন ছিল না। কিন্তু গতকাল ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে গিয়ে এসব দেখতে পান এ প্রতিবেদক। সেখানে দেখা মেলে শত শত ড্রাম, বিভিন্ন কনটেইনার ও প্যাকেটে নানা ধরনের কেমিক্যাল। রঙ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো এসব কেমিক্যাল, পাউডার এবং লিকুইড। কেমিক্যালে ভরপুর পুরো বেজমেন্ট।

গতকাল ওই ভবনের বেজমেন্টের প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায় কিছু প্লাস্টিকের ঝুড়ি। এরপরই বি¯ু‹ট কালারের বেশ কিছু ড্রাম সারি সারি করে রাখা। তার ওপরে সিসি ক্যামেরা। ওই ক্যামেরার নিচেই একটি কলাপসিবল গেট। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলের লাইটের আলো জে¦লে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বস্তা বস্তা রাসায়নিক দ্রব্য ও শত শত ড্রাম। আর একটু ভেতরে ঢুকতেই দেখা মেলে ফায়ার সার্ভিসের দুই তিন সদস্য লাইট জ¦ালিয়ে তালিকা করছেন বেজমেন্টে থাকা মালামালের। তারা জানিয়েছেন বেজমেন্ট ১১ ধরেনের এলিম্যান্ট পেয়েছেন তারা। 

ফায়ার সার্ভিস জানায়, এই ভবনটিতে শুধু অননুমোদিতভাবে রাসায়নিক মজুদ করা হয়েছে তাই নয়, এমনকি মজুদ করার ক্ষেত্রে মানা হয়নি কোনো নিয়মকানুনও। চুড়িহাট্টার চৌরাস্তার সামনে লাগা আগুন যদি বেজমেন্ট পর্যন্ত আসত তাহলে আগুনের ভয়াবহতা ও নির্মমতা কোনপর্যায়ে যেত তা কল্পনাতীত।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব সহকারী পরিচালক (ঢাকা) সালেহ উদ্দিন বলেন, এই বেজমেন্টে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক রয়েছে, এসবের সাথে আমরা হয়তো পরিচিতও না। যেগুলো দেখছি এর অধিকাংশই ডাইয়িং এবং প্রিন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হতো।

সব কেমিক্যালই বিপজ্জনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকার কথা, সেখানে গোডাউন করা হয়েছে, এমনকি গোডাউনে মালপত্র রাখার যেসব নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলোও মানা হয়নি। পুরোটাই নিয়ম বহির্ভূতভাবে বেজমেন্টে গোডাউনে রাসায়নিক রাখা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাজাহান শিকদার বলেন, ভবনটির বেজমেন্টে যেভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল রাখা ছিল, আগুন যদি কোনোভাবে বেজমেন্টে চলে যেত ভবনটি বিস্ফোরিত হয়ে সাথে সাথে ধসে পড়ত।

তিনি বলেন, বেজমেন্টে এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল রাখা অপরাধ। আবাসিক এলাকায় এ ধরনের কেমিক্যাল রাখা উচিত নয়। অথচ এখানে দুই পাশের পার্কিংয়ের জায়গায় বোঝাই করে এসব কেমিক্যাল গুদামজাত করে রাখা হয়েছে। তাই আগুন নেভানোর কাজ করার সময় আমরা বেজমেন্টে তিনটি ইউনিট দিয়ে পানি দিয়েছি, যাতে আগুন বেজমেন্টে না ছড়ায়।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনে পারফিউমের গোডাউন ছিল। ওই ব্যবসায়ী কিছু দিন আগেই ২০ কোটি টাকার চালান এনে গোডাউনে জমা করেছিলেন। এলাকার সবাই এ তথ্য জানে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। কিন্তু ভবনের ভেতরে অনেক কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ ছিল। সেগুলোর কারণেই আগুন এত দ্রুত ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

কি ধরনের কেমিক্যাল ছিল জানতে চাইলে জুলফিকার রহমান বলেন, ওই ভবনে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল, যা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া সেখানে পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর পারফিউমের বোতলগুলো বোমের মতো বিস্ফোরণ ঘটেছে। এসবই কিন্তু এক ধরনের কেমিক্যাল। আর এই কেমিক্যালের জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে এত বেশি সময় লেগেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/390528