২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:৫৩

১০ বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ২ হাজার ৫৮ জন

মুহাম্মদ নূরে আলম : আধুনিক নগর জীবনে যেটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সেটি হচ্ছে নিরাপদ পরিবেশ। যা অফিস-আদালত থেকে শুরু করে শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, বাসা-বাড়ি সব জায়গায় দরকার নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ। নিরাপদ পরিবেশের কথা চিন্তা করলেই প্রথমেই আসে অগ্নি নিরাপদ ব্যবস্থার কথা। কেননা দেশে বড় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এর ভয়াবহতা যে কি নির্মম তা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছে। ২০১৮ সালে সারা দেশে ১৯ হাজার ৬৪২টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ১৩০ জন নিহত ও ৬৬৪ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে দমকল বাহিনী বা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে। দমকল বাহিনীর এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে গত বছর ৪৩০ কোটি টাকার মতো। বেশিরভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাস সিলিন্ডার, ছুঁড়ে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট ইত্যাদি থেকে।

এদিকে রাজধানী ঢাকার বস্তি ও শিল্পখাতে নিয়মিত বিরতিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। হতাহত হলেই কেবল মামলা হয়, তাও অপমৃত্যুর। এরও আবার কোনো তদন্ত হয় না। ক্ষতিপূরণও প্রদান করা হয় না। যাও কিছু হয় ক্ষতির তুলনায় তা অতি নগণ্য। গত ১০ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় ২ হাজার ২০০টির বেশি অগ্নিকা- ঘটলেও একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ।

স্বাভাবিকভাবেই এসব অগ্নিকাণ্ডে কাউকে দায়ীও করা যায়নি। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার মতো। তবে ক্ষয়ক্ষতির যে পরিমাণ দেয়া হয়েছে বাস্তবে তার পরিমাণ অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

ফায়ার সার্ভিসের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এসব অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বাসা বাড়ি বা রান্না ঘর থেকে।

কলকারখানায় আগ্নিকান্ড ঘটেছে কয়েক হাজারের মতো, আর দোকান-পাটে প্রায় দুই হাজার। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ প্রধানত ছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম।

বাসাবাড়িতে গ্যাস লাইন থেকেও অগ্নিকান্ড হয়েছে। এখন দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে এবং সে জন্য অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিও বেড়েছে। তিনি বলেন, দমকল বাহিনীর এখন সক্ষমতা বেড়েছে।

২০ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবনে অগ্নিনির্বাপনের কাজ করার মত যন্ত্রপাতি ও সক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। তবে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছার জন্য যানজট, পানির উৎস-এগুলো এনখও একটা বড় সমস্যা বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েই চলেছে। ফলে জীবনহানি, অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত বছরের সব অগ্নি দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে। এরপরই বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গ্যাসের চুলা থেকে। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে রাজধানীর চকবাজার এলাকায় আগুন লেগে এখন পর্যন্ত ৮১ জনের মৃত্যু হয়। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়েছে আরো কয়েক শতাধিক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ১৯ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ১০ বছরে সারাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৫৮ জন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৮২৫ জন। ক্ষতির পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ বৈদ্যুতিক ত্রু টির কারণে ঘটছে। দেশে বিদ্যুৎ ও আগুনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও বাড়ছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকান্ড কখন ঘটবে সে বিষয়টি অনুমান করার উপায় নেই। তবে সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও তার ইত্যাদি ব্যবহারের সময় পণ্যমান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বাড়িঘর ও কলকারখানায় অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে জানালেও প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে বড় অগ্নিকান্ড সবার দৃষ্টি কাড়লেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আগুনের ঘটনা ঘটছে। বৈদ্যুতিক ত্রুুটির পাশাপাশি সিগারেটের আগুন, গ্যাসের চুলা, গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্ফোরণ, আগুন নিয়ে খেলা ও অসতর্কতাসহ নানা কারণে ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি ভস্মীভূত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অগ্নিকান্ড কমিয়ে আনতে হলে সাধারন মানুষকে আরো অধিক সচেতন হতে হবে। একই সাথে প্রশিক্ষনেরও প্রয়োজন রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্যাস লাইন লিকেজ বা গ্যাসের চুলা থেকে অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষকে আরো সচেতন হওয়া উচিত। এছাড়া যে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে সেটির মান সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। একই সাথে জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকলকে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সচেতনামূলক কাজ করা উচিত বলে মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ মন্তব্য করেন।

ফায়ার সার্ভিসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আমাদের দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। যে ক্ষেত্রে আগুন নেভানো, মানুষকে সরিয়ে নেয়া এবং জরুরি উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা দরকার, সেসব ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবল নেই। তাছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সাধারন মানুষের যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার তাও নেই বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।

সংস্থাটির হিসাবে, গত ১০ বছরে শিল্পে অগ্নিদুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতি হয় ২০১৫ সালে। ওই বছর এক হাজার ১৩টি অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৬৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে দেশের সাত বিভাগে ২৫৮টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ৩২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে ৯৬১টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৭৩ কোটি টাকা।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে শিল্পে অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির প্রায় ২৫ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত ও শপিংমল সেক্টরে ১০ শতাংশ মতো ক্ষতি হয়েছে। গত ১০ বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার ২১৫টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায়৪সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ১৫২টি অগ্নিদুর্ঘটনায় ৮৫ কোটি, ২০১৫ সালে ২১৩টি দুর্ঘটনায় প্রায় ২৮ কোটি ও ২০১৬ সালে ১৯০টি অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। তবে বাস্তবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট খাতে ক্ষতির শিকারগ্রস্তরা।
অপরদিকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অর্থনীতিতে উল্যেখ করার মতো অবদান রাখছে বস্তিগুলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তি শুমারি অনুযায়ী, বস্তির বাসিন্দাদের ১৩ শতাংশের বেশি দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পের কর্মী।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) বিভাগ এ প্রসঙ্গে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আগুন লাগানোর পর অপরাধের সব আলামতই নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আগুনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো তদন্তেও কিছুটা সময় লেগে যায়। তাছাড়া বস্তিতে কোনো সিসি ক্যামেরাও থাকে না, যাতে ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়। দোষীদের শাস্তি না হওয়ায় নিয়মিতই ঘটছে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে শুধু রাজধানীর বস্তিগুলোতেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৭ জন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২৯টি। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার। পরের বছর অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩-এ। ১২ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি এতে ক্ষতি হয় ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার। ২০১৫ সালে রাজধানীর বস্তিগুলোয় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ওই বছর ৪৭টি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় তিনজন আর ক্ষয়ক্ষতি হয় ১ কোটি ১১ লাখ টাকার। পরের বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ২৭টিতে। এতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নিহত হয় একজন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রাজধানীর বস্তিগুলোয় ৩২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় একজন। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকায়।

২০১২ সালে ২৪ নভেম্বর তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ নিহত হন। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীস্থ নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন নারী ও শিশুসহ ১২৪ জন নিহত হন। ২০০৯ সালের ১৩ই মার্চ বসুন্ধরা সিটির আগুন। ওই আগুনে প্রাণহানির তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও পুরো ঢাকা শহরকে এ ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিলো তীব্রভাবে।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগের বউবাজার বস্তিতে লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১১ জন। ২০১২ সালে গরীব অ্যান্ড গরিব গার্মেন্টসে লাগা আগুনে নিহত হন ২১ জন। এছাড়া হামীম গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডে ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালের ২৮ জুন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে আগুনে পুড়ে ৭ নারী পোশাক শ্রমিক নিহত হন। ২০০৫ সালের এপ্রিলে স্পেকট্রামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৪ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন প্রায় ৮০ জন। ২০১৩ সালে সভারের রানা প্লাজা ধ্বসে ১১০০ শ্রমিক নিহত হন।

http://www.dailysangram.com/post/366132