২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ২:২৪

ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা

প্রতিদিন ধার করে চলছে কিছু ব্যাংক ; বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৭ দিনে ধার সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে কলমানি মার্কেটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত সাত কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো ধার নিয়েছে ৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বুধবারই ১৪টি ব্যাংক ধার করেছে ২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন কিছু কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে চলছে। স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্খা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে যেসব ব্যাংকের ডলারের সঙ্কট ছিল তারা অন্য ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে ডলার কিনে নিচ্ছে। এতে টাকার বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই টাকার সঙ্কট ছিল, এর সাথে ডলারের বাড়তি বিনিময় মূল্য পরিশোধে টাকার আরো টান পড়েছে। এ কারণেই ১৪টি ব্যাংক এক সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গত বুধবার ধার নেয়ার জন্য আসে। ওই দিন ১১টি প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ও ননপিডি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি ৬ লাখ টাকা। আর একই সাথে বিশেষ তহবিল জোগান বাবদ ৩টি পিডি ব্যাংককে ধার দেয়া হয়েছে ১৭১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি ১০০ টাকা ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে সুদ গুনতে হয়েছে ৬ টাকা।

সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ জোগান দেয় কিছু ব্যাংক। যাদেরকে প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক বা সংক্ষেপে পিডি ব্যাংক বলা হয়। আর ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কট দেখা দিলে ট্রেজারি বিল ও বন্ড জামানত রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য টাকা ধার নেয়। এটাকে রেপো বলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, পিডি ব্যাংকগুলো তাদের মোট মূলধনের ১০০ ভাগের অতিরিক্ত এবং নন-পিডি ব্যাংকগুলো ৮০ ভাগের অতিরিক্ত এক বছরের কম সময়ের তহবিল (স্বল্পমেয়াদি তহবিল) অর্থাৎ কলমানি মার্কেট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বা অন্য যেকোনো উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কিছু কিছু ব্যাংক এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করে আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। ফলে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিল কমে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ইতোমধ্যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমলেও কোনো কোনো ব্যাংকের আন্তঃব্যাংক নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি তহবিল অর্থাৎ আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। অথচ দেদারছে তারা ঋণ দিচ্ছে। কেউ কেউ অধিক মাত্রায় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলছে। দায় মেটানোর সময় সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে। এ জন্য তারা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে দায় মেটাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তারা প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার নিচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে চলছে। গত ৫ কার্যদিবসের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনই ১৩ কোটি টাকার ওপরে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করেছে। আর ১৮ ফেব্রুয়ারি ৯৭ কোটি টাকা ধার করেছে এ বাজার থেকে। ইউসিবিএল ব্যাংক ১৪, ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করেছে। এর মধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২২৫ কোটি টাকা ও ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৬১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ধার করেছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে। এভাবে আরো কয়েকটি ব্যাংক প্রায় প্রতিদিনই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নিয়মিত কলমানি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে ব্যাংকের দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্যাংকের দায়-ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার ওপর নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি তহবিল সংগ্রহের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক যাচাই-বাছাই জোরালো করবে। একই সাথে ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ নন-ফান্ডেড দায় সৃষ্টি করছে, অর্থাৎ কী পরিমাণ পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে তার তথ্যও যাচাই-বাছাই জোরালো করা হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/390315