২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর ওই এলাকায় কেমিক্যাল কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর পর ব্যবসায়ীদের চাপে সম্প্রতি আবারো শর্তসাপেক্ষে ওই এলাকার কেমিক্যাল কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন শুরু করে সংস্থাটি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি পারফিউম কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নবায়নও করা হয়। এর একদিন পরই ঘটল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যাতে প্রায় ৮০ জনের বেশি মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। এরপর মেয়র বলছেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরাতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ ব্যাপারে তিনি জোর পদক্ষেপ নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি নগর ভবনে ব্যবসায়ীদের সাথে কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ও কেমিক্যাল পল্লীতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর’ শীর্ষক সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি মেয়রকে উদ্দেশ করে বলেন, যতদিন পর্যন্ত পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা কেমিক্যাল পল্লীতে স্থানান্তর না হয়, ততদিন ব্যবসায় করার সুযোগ দিন। তাদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ দিন। ব্যবসায়ীরা যেন পুলিশি হয়রানির শিকার না হন সেদিকটা খেয়াল করতে তিনি মেয়রের প্রতি অনুরোধ করেন। সভায় অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, নিমতলির ঘটনার পর আমরা ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছি না। এ ব্যবসায় আমাদের রুটি রুজি, এটা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ছাড়া অন্যগুলোর ব্যবসায় করার সুযোগ দিন। তা নাহলে আমাদের পুরান ঢাকার ব্যবসায় অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে মেয়র অনেকটা নমনীয় হন। এতদিনের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শর্তসাপেক্ষে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। মেয়র বলেন, আমরা ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাই না। তবে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদের। এ সময় তিনি ঘোষণা দেন, ওই এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হবে। তখন যেসব কেমিক্যাল কারাখানা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয় বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেসব কারখানাকে ‘অন দ্য স্পটে’ ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা হবে। আর ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কেমিক্যাল কারখানা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরপর মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাবুবাজার মিটফোর্ড এলাকা থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করে সিটি করপোরেশন। এ কর্মসূচির উদ্বোধনকালে মেয়র বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়েছি যে, ২৯টি কেমিক্যাল অত্যন্ত দাহ্য। এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং এগুলো থেকে যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। এ দাহ্য পদার্থগুলো যেসব দোকান বা গোডাউনে পাওয়া যাবে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে সেসব সিলগালা করে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে সেসব ব্যবসায়ীকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এ সময় মেয়র আরো বলেন, আমাদের পরিদর্শনের সময় যেসব দোকানে এই ২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল পাওয়া যাবে না, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য সহযোগিতা দেয়া হবে।
দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিয়ে সাঈদ খোকন বলেন, যে কেমিক্যালগুলো ঝুঁকিপূর্ণ নয় সেগুলো স্যাম্পল হিসেবে দোকানে সাজাবেন। অতিরিক্ত কেমিক্যাল বোঝাই করবেন না। যেগুলো বিক্রি করবেন সেগুলো আশাপাশের বাসাবাড়ি বা গোডাউনে না রেখে, একটু দূরে কোথাও গোডাউন করে রাখবেন। সেখান থেকে সাপ্লাই দেবেন। এদিনই মেয়রের উপস্থিতিতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করে দেয়া হয়। এগুলো হলো- রিপন পারফিউমারী অ্যান্ড কেমিক্যাল, উম্মে হানি পারফিউমারী অ্যান্ড কেমিক্যাল, মডার্ন পারফিউমারী অ্যান্ড কেমিক্যাল, আমীন পারফিউমারী অ্যান্ড কেমিক্যাল ও সজিব কেমিক্যাল।
এর পরদিনই বুধবার রাতে চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রাথমিক তথ্য মতে, রাস্তায় থাকা একটি পিক-আপ গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে এ আগুনের সূত্রপাত। তবে এর পাশেই ছিল পারফিউমের গোডাউন। আর এ গোডাউনের কারণে আগুন আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনগুলোতে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ পরিস্থিতিতে মেয়র সাঈদ খোকন গতকাল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে জানিয়েছেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরাতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ব্যাপারে জোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণাও দেন তিনি।
এদিকে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় অবৈধ কারখানা উচ্ছেদে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়েছে পুলিশও। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো: আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল বলেন, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এ এলাকায় আমরা অভিযান চালাচ্ছিলাম। অননুমোদিত ফ্যাক্টরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, জরিমানা হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছে, দুই মাস বন্ধ থাকে, আবার স্থানীয়ভাবে চুরি করে এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এ জন্য এবার সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার প্রথম কারণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। সেটিও হয়তো সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত কিন্তু ওই ভবনের নিচতলায় ছিল প্লাস্টিকের দানা ও তিন তলায় ছিল বডি স্প্রের গোডাউন। আমার মনে হয় মিলিয়ন মিলিয়ন বডি স্প্রে ওখানে মজুদ ছিল।
