২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:১১

৯৮ শতাংশ হাসপাতাল অগ্নি নিরাপত্তার ঝুঁকিতে

ঢাকা মহানগরীর ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল অগ্নি নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। রাজধানীর ৪৩৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ২৪৯টি ঝুঁকিপূর্ণ। আর ১৭৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিককে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে মাত্র ১১টি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের এক জরিপে এই চিত্র উঠে আসে। গতকাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত ‘হাসপাতালে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এই তথ্য জানানো হয়। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাসপাতালসমূহের মালিক ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এই মতবিনিময় করে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান পিএসসি’র সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ।

মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ প্রবন্ধে বলেন, হাসপাতালগুলোতে যে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি তাতে দেখা যায় ঢাকা মহানগরীর ৪৩৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ২৪৯টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৭৩টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে ১১টি। ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের সংখ্যা আমাদের সার্ভেকৃত হাসপাতালের মোট সংখ্যার ৯৮ শতাংশ। তিনি বলেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগী, ভবনে র‌্যাম্প ও জরুরি সিঁড়ির অভাব, স্টোরিং গাইডলাইন-এর অভাব, দক্ষ ফায়ার সেফটি প্রফেশনালের অভাব, ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেমের অভাব, আর্থিং ব্যবস্থা না থাকা, এলপিএস (লাইটিং প্রটেকশন) সিস্টেম না থাকা, পর্যাপ্ত পানির অভাব, আবাসিক ভবনে হাসপাতাল স্থাপন, ইভাকুয়েশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব ইত্যাদির কারণে হাসপাতালগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যেসব অগ্নিঝুঁকি বিরাজ করে তা হলো অক্সিজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদির ব্যবহার, রান্নাঘর স্থাপন; লন্ড্রি হাউসের অব্যবস্থাপনা, অনিরাপদভাবে বয়লার ব্যবহার, বৈদ্যুতিক স্থাপনা (জেনারেটর, ট্রান্সফরমার ইত্যাদি), ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন; কার পার্কিং; খোলা বাতির ব্যবহার (মোমবাতি, মশার কয়েল ইত্যাদি), ধূমপান, অপরিকল্পিত স্টোর, দুর্বল হাউজকিপিং ইত্যাদি।

পরিচালক শাকিল জানান, ফায়ার সার্ভিস থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে সার্ভে পরিচালনা করে ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়, ঝুঁকির উপর ভিত্তি করে তা নিরসনের জন্য সুপারিশমালা প্রণয়ন, অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান, নিয়মিত মহড়া অনুশীলন, অগ্নি দুর্ঘটনা বিষয়ক হাসপাতালে সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদারে সুপারিশমালা তুলে ধরে তিনি বলেন, নিরাপত্তা কমিটি গঠন, ফায়ার রিস্ক এসেসমেন্ট, আপদকালীন কর্মপরিকল্পনা (ফায়ার অ্যান্ড সেফটি প্ল্যান), ফায়ার সেফটি অফিসার এবং ফায়ার ফাইটিং টিম (২৪/৭) সংরক্ষণ, নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণের প্রশিক্ষণ ও মহড়া পরিচালনা, ইভাকুয়েশনের জন্য বহির্গমন পথ সর্বদা বাধামুক্ত ও আলোকিত রাখা, ফায়ার অ্যালার্ম ও ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন, পিএ সিস্টেম সংরক্ষণ, বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র সংরক্ষণ, রিফিউজ এলাকা এবং সেফটি লবি সংরক্ষণ, এসেম্বলি এরিয়া সংরক্ষণ, ফায়ার পাম্প সিস্টেম সংরক্ষণ, পর্যাপ্ত পানির রিজার্ভার সংরক্ষণ, স্ট্যান্ডপাইপ সিস্টেম সংরক্ষণ, ফায়ার হোজ এবং ফাস্ট এইড হোজ কানেকশন সংরক্ষণ, ফায়ার ডিপার্টমেন্ট কানেকশন এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট সংরক্ষণ, ফায়ার লিফ্‌ট ও হাসপাতাল লিফ্‌্‌ট সংরক্ষণ, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপন ইত্যাদি কথা সুপারিশে তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, হাসপাতালগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা একটি স্পর্শকাতর ও উদ্বেগজনক বিষয়। স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে হাসপাতালের দুর্ঘটনায় জীবনহানির আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। কারণ একটি হাসপাতালে যারা অবস্থান করেন তাদের বেশির ভাগই থাকেন রোগী, যাদের পক্ষে অন্যের সাহায্য ছাড়া দুর্ঘটনার সময় বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য পূর্ব প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নি দুর্ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে আমরা সেখানে একটি মহড়া করেছিলাম। আমরা মনে করি, সেই মহড়ার সুফল হিসেবে সেখানে জীবনহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে আমাদের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করা হলে হয়তো অগ্নি দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতির পরিমাণও সহনীয় পর্যায়ে থাকতো। তিনি বলেন, পুরনো হাসপাতালগুলোর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো আপস করা যায় না। হাসপাতাল চালুও রাখতে হবে আবার তা নিরাপদও রাখতে হবে। তিনি জরুরি মুহূর্তে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসার জন্য পজিটিভ প্রেসারে আইসোলেটেড বহির্গমন জরুরি সিঁড়ি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ফায়ার ডোর স্থাপনের মাধ্যমে এ ধরনের ইমার্জেন্সি এক্সিট সংরক্ষণ করতে পারলে জীবনহানির আশঙ্কা কমে যাবে। এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সচেতনতা, প্রতিটি ফ্লোরে টিম ও স্বেচ্ছাসেবক থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরো বলেন, প্রথম আধা ঘণ্টা আগুনের সঙ্গে ফাইট করার প্রস্তুতি থাকতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমি মনে করি আমাদের এই প্রাণশক্তি সঞ্চিত হয়েছিল গত অক্টোবরে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আমাদের মহড়া অনুশীলনের মাধ্যমে। সেখানে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারতো। তিনি এজন্য হাসপাতালগুলোতে মহড়া জোরদারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপ-সচিব আনিছুল হক বলেন, হাসপাতালে অগ্নি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সচেতনতা হলো বড় বিষয়। বিদ্যমান আইনের সংশোধনের জন্য জনগণের মতামতের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আরো মতামত ব্যক্ত করেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. গণি মোল্লা, ল্যাবএইড-এর জিএম হাবিবুল আলম, বারডেম হাসপাতালের আমিনুল ইসলাম, জাতীয় মানসিক হাসপাতালের কামাল উদ্দিন আহমেদ, ব্রেন অ্যান্ড মাইল্ড হাসপাতালের এজিএম মজিবর রহমান, ওএসবি চক্ষু হাসপাতালের ডা. স্বপন কুমার ভৌমিক, পিডব্লিউডির প্রকৌশলী নাসিরুল রেজা, ঢাকা সেন্ট্রাল স্পেশালাইজড হাসপাতালের হেড অফ অ্যাডমিন মজিবর রহমান, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক কর্নেল (অব.) শামসুল আলম, মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আব্দুর রশিদ, উত্তরা মহিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. শাহরিয়ার প্রমুখ। মতবিনিময় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) যুগ্ম সচিব মো. হাবিবুর রহমানসহ ঢাকার ৪ শতাধিক হাসপাতালের মালিক ও পরিচালক।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=160455&cat=6