২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৬

এখনো রক্তপাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি

মানুষ সত্য বলবে, এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টি মানবিক মর্যাদার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। এ কারণেই মিথ্যাকে মানুষ ঘৃণা করে। আর সব ধর্মেই মিথ্যাকে পাপকর্ম হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এরপরও মানুষ মিথ্যা বলে। প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ কখনো মিথ্যা বললেও নিজের কাছেই ছোট হয়ে যায়। সে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে না, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও পারে না। বিবেকের দংশনের কারণেই এমনটি হয়। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় বিচিত্র সব কা- লক্ষ্য করা যায়। বড় মাপের মানুষরাও এখন অবলীলায় মিথ্যা বলে যান। মিথ্যাটা তারা উচ্চকণ্ঠে বলেন, কৌশল করে বলেন এবং বলেন বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যেও।

ফলে প্রশ্ন জাগে ওইসব মানুষের মধ্যে বিবেক নামক জিনিসটির কি কোন অস্তিত্ব নেই?
অবাক হতে হয় মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জাপানের ‘আসাহি শিমবুন’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান মিন অং লেইং রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, এমন অভিযোগ তার দেশের জন্য অপমানজনক। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনায় মিন অং লেইংকে বিচারের আওতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক মহল যে আহ্বান জানিয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এমন বক্তব্য রাখেন। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী নির্মম নির্যাতন চালায়। হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। বিশ্ব গণমাধ্যমে কুৎসিত সেই নির্যাতনের খবর মুদ্রিত হয়, হয় সম্প্রচার। ফলে গড়ে ওঠে বিশ্ব জনমত, সবাই এখন মিয়ানমারের শীর্ষ নেতাদের বিচার চাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন ওই সেনাপ্রধান এবং আরো পাঁচ জেনারেলকে ‘গুরুতর অপরাধে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়’ এনে বিচারের সুপারিশ করেছিল। ওই সেনাপ্রধান সাক্ষাৎকারে শুধু বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন নি। রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে চলে আসার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার কারণ হতে পারে, তাদের আত্মীয়দের সাথে অন্য দেশে পাড়ি জমানো। মিথ্যাচার আর কাকে বলে! সেনাপ্রধানের নৈতিক মান যখন এমন হয়, তখন সৈনিকদের নৃশংসতার মান সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

নৈতিকতা বিসর্জন দিলে দ্বন্দ্বের মাত্রা বেড়ে যাবে, সবখানেই। ভারতের আসামে বিজেপির ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানানোর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবে না বলে মন্তব্য করেছে ‘অল অসম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসসু)’। বিজেপি আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলেও সংগঠনটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। রাজ্য সভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটি এ মন্তব্য করেছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি পার্সটুডে পরিবেশিত খবরে বলা হয়, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাতিল হওয়ার বিষয়ে ‘আমসুর’ উপদেষ্টা আইনজীবী আজিজুর রহমান রেডিওতে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটা বিজেপির সম্পূর্ণ পরাজয়। নরেন্দ্র মোদি বলেন যে, উনি ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মানুষ, উনি যে কোন কাজ করতে পারেন। কিন্তু অসমবাসী ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলবাসী গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করে বিরোধী দলসমূহের সহযোগিতায় ৫৬ ইঞ্চির দম্ভকে প্রতিহত করেছে। আর কোন কারণেই আগামী দিন ৫৬ ইঞ্চি ছাতির দক্ষতা থাকবে না, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে।’

আমসুর উপদেষ্টা আজিজুর রহমান আরও বলেন, ‘ভারতবাসী জানেন ভারতের যত জ্ঞানী মানুষ তারা সংবিধান প্রণয়ন করে গেছেন এবং সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী ভারতবর্ষ চলবে। এখানে কোন ৫৬ ইঞ্চির দম্ভ চলবে না। এর ফলে বিজেপির ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানানোর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবে না। এরই মধ্যে অসম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যের মানুষ বিজেপির কুচক্রান্ত বুঝে গেছেন। এ জন্য তারা মোদির ৫৬ ইঞ্চির ছাতির সঙ্গে নেই। ভারতের যে হিন্দু বলয়, সেই ছত্তিসগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ- এসব রাজ্যের মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে জন্য ওনারা যতই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির কথা বলুক না কেন, ওনারা আগামী দিনে আর সরকারে আসতে পারবেন না। ভারতবাসী এবার সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মহাত্মা গান্ধীর যে স্বপ্ন ছিল তার পক্ষে থাকবে বলে আমরা আশাবাদী।’

আমসু নেতা আজিজুর রহমান তো আশাবাদের কথা বললেন। কিন্তু অসমের অর্থ, স্বাস্থ্য ও পূর্তমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্বশর্মা বহুল আলোচিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন। একে অসমবাসীর পরাজয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিল পাস না হলে রাজ্যের ১৭টি নির্বাচন কেন্দ্র বাংলাদেশী মুসলমানদের হাতে চলে যাবে। এমন বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে আজিজুর রহমান বলেন, এখানে বাংলাদেশের কোন লোক এসে বিধায়ক হতে পারবেন না। এটা হিমন্ত বিশ্বশর্মার হতাশার বহিঃপ্রকাশ। এখন দেখার বিষয় হলো, ভারত কোন্্ পথে যায়। মহাত্মা গান্ধীর পথে, নাকি মোদির পথে?

আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় জম্মুতে কাশ্মীরী ও স্থানীয় মুসলমান বাসিন্দাদের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহ। তারা বলেন, হামলার দায় মুসলমানদের নয়, সন্ত্রাসীদের। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদদ থাকার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভকারীরা মিছিলে মিছিলে মুখরিত করে রেখেছিল জম্মু শহর। স্থানীয় প্রশাসন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে জারি করেছে কারফিউ।

উত্তেজিত হওয়া সহজ, উগ্র হওয়াও কোন কঠিন বিষয় নয়। জম্মুতে কাশ্মীরী ও স্থানীয় মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনায় আমরা তেমন চিত্রই লক্ষ্য করলাম। তবে ১৬ ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রিত ওই খবরটির একদিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারিতে আমরা আর একটি খবর দেখলাম আনন্দবাজার পত্রিকায়। খবরটিতে বলা হয়, সামরিকতায় আচ্ছন্ন জম্মু-কাশ্মীরে দেশরক্ষার পেশাগত দায়িত্বের বলি হয়েছেন বাবলু সাঁতরাও। তবুও প্রতিশোধের উন্মত্ততা নেই স্বামীহারা স্ত্রী মিতার মধ্যে। জঙ্গী দমনের নামে রক্তপাত কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চান না তিনি। স্বামীহারা মিতার কাছে প্রতিশোধ মানেই নতুন রক্তপাতের আশংকা। যুদ্ধ মানেই উন্মত্ততা। তাই শান্তিপূর্ণ পথে কাশ্মীর সংকট সমাধানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানালেন বাঙালি জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা।

বর্তমান সভ্যতায় মিতার জীবনদৃষ্টি যেন ব্যতিক্রম। তিনি বৃহস্পতিবারের জঙ্গী হামলাকে প্রথমত নিরাপত্তাজনিত ঘাটতি হিসেবে দেখছেন। সংবাদ মাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘তেমন নিরাপত্তা ছিল না, থাকলে এমন ঘটনা দেখতে হতো না।’ এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পুলওয়ামা হামলার কঠোর জবাব দিতে যে কোন হামলার কঠোর জবাব দিতে যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। এ প্রসঙ্গে মিতা বলেন, ‘এইভাবে কোন সমাধান হতে পারে না।

যতোটা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় সেই চেষ্টা করুক সরকার।’ স্বামী হারিয়েও রক্তপাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার মিতা। তিনি আরো বলেন, ‘শুধু তো আমাদের দেশে নয় সারাবিশ্বে কত তাজাপ্রাণ শেষ হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। আজ যদি নতুন করে যুদ্ধ বাধে তাহলে আবার মায়ের কোল খালি হবে। এমনটি হোক তা আমি চাই না।’ এখন দেখার বিষয় হলো ভারত কোন্ পথে যায়।

http://www.dailysangram.com/post/365910