১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৭:২৯

নগরবাসীর ভোগান্তি

মেট্রোরেলের দ্বিতীয় দফা নির্মাণ শুরু

রাজধানীর ফার্মগেট থেকে শাহবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তার বেশিরভাগ স্থান টিনের বেরা দিয়ে ঘেরাও করে দখলে নিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। দুদিকের সরু অংশ নিয়ে কোনোমতে চলাচল করছে যানবাহন। তাতে দিনভর যানজটের ভোগান্তি লেগেই আছে। এরই মধ্যে এই পথের শতাধিক বাসের রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে করে যাত্রীদের নতুন করে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত মাসের ১৫ তারিখ থেকে মেট্রোরেলের কাজের সুবিধার্থে বেশ কিছু বাসের রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। মিরপুর থেকে ফার্মগেট হয়ে যে সব বাস বাংলামোটর-শাহবাগ হয়ে গুলিস্তান-মতিঝিল আসতো সেগুলো এখন সংসদ ভবন থেকে ঘুরে এলিফ্যান্ট রোড অথবা তেজগাঁও-মগবাজার হয়ে ঘুরে আসছে। এতে করে হাজার হাজার যাত্রীর পথ এলোমেলো হয়ে গেছে। যাত্রীদের কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেক সময় রাত হয়ে যাচ্ছে।

হাতিরপুলের এক অভিজাত মার্কেটে সেলসম্যানের কাজ করেন আব্দুল লতিফ। মিরপুর ১১নং সেকশনের বাসা থেকে বের হয়ে বাসে চড়ে এসে নামেন বাংলামোটরে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে তার কর্মস্থল মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। আব্দুল লতিফ জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন হাতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি বাসা থেকে বের হন। কখনও কখনও যানজটের মধ্যেই সেই দুই ঘণ্টা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে বাস মিরপুর থেকে আর সোজা পথে আসছে না। ফার্মগেট, বাংলামোটর এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ায় মিরপুরের বাস এলিফ্যান্ট রোড হয়ে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছে। এ কারণে লতিফকে নামতে হচ্ছে শুক্রবাদে। সেখান থেকে সরাসরি কোনো বাস না থাকায় পায়ে হেঁটেই হাতিরপুল পর্যন্ত আসতে হচ্ছে তার। এতে হাতে আরও এক ঘণ্টা সময় রাখতে হচ্ছে। আব্দুল লতিফের কথায়, কাজ শেষে ফিরতে গিয়ে ভোগান্তি আরও কয়েক গুণ বেশি। বাংলামোটর এলাকায় কোনো বাস না থাকায় পায়ে হেঁটে এলিফ্যান্ট রোড বা শুক্রবাদে যেতে হয়। রুট এলোমেলো হওয়াতে বাসের দেখা সহজে মেলে না। হাজার যাত্রীর জন্য মাঝে মধ্যে দু’একটা বাস আসে। তখন সেগুলোতে চড়ার মতো উপায় থাকে না। কাওরানবাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী ফারুক জানান, পুরো রাজধানীর যানজট এখন কাওরানবাজারমুখি। অর্থাৎ কাওরানবাজারের আশপাশে সবগুলো এলাকাতেই এখন দিনভর যানজট লেগে থাকে। বিকালে বসুন্ধরা সিটিতে গাড়ির ভিড়ের কথা উল্লেখ করে ওই ব্যবসায়ী বলেন, তখন কি যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হয় তা ভুক্তভোগিরাই জানেন। তার ভাষায়, কদিন পরে বিপদে না পড়লে আর কেউই এই এলাকায় আসবে না। কিন্তু ফারুকের মতো যারা না এসে পারবেন না তাদের জন্য ‘মহাবিপদ’। বললেন, কবে যে এই বিপদ থেকে রেহাই মিলবে কে জানে?

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশের কাজ শুরু হওয়ায় গত ১৫ জানুয়ারি থেকে বেশ কিছু গণপরিবহনের রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। মিরপুর রোড থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে আসা বাসগুলোকে ফার্মগেটের দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এই রুটের বাসগুলো বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো রুটের বাস মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আপাতত কিছুদিন বাসগুলো সায়েন্সল্যাবরেটরি হয়ে শাহবাগ দিয়ে মতিঝিল-গুলিস্তান আসবে। কাজের অগ্রগতির পর শাহবাগের রাস্তাও বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। এখন কেবল ক্যান্টনমেন্ট রুটের বাস ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল-গুলিস্তানের দিকে আসতে পারছে। জানা গেছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু পথ পরিবর্তন হবে। ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সকাল আটটা থেকে সকাল সাড়ে দশটা এবং বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সপ্তাহে রবি থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন মোট সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত প্রাইভেট কার চলাচল বন্ধ রাখা হতে পারে। প্রথম দিকে রাজধানী ‘গ’ সিরিজের প্রাইভেট কারগুলো বন্ধ রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে পরবর্তী সময়ে ‘ক’ ও ‘খ’ সিরিজের প্রাইভেট কারগুলো বন্ধ রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। তবে অ্যাম্বুলেন্স, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, রোগী বহনকারী, সংবাদপত্র ও ওষুধ পরিবহনের মতো জরুরি সেবার গাড়িগুলো এর আওতার বাইরে রাখা হবে।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রাস্তাটির প্রস্থ প্রায় ২২ মিটার। এর মধ্যে সড়কের দুই পাশের মধ্যবর্তী ১১ মিটার অংশে মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য টিনের বেরা দিয়ে আলাদা করে নেয়া হয়েছে। এতে করে রাস্তার এক পাশে মাত্র ৫ মিটারের মতো জায়গা থাকছে। ওই রাস্তা দিয়েই চলছে যানবাহন। চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তার এক পাশে যতোটুকু জায়গা আছে তাতে একটা বাস বা প্রাইভেট কারের পাশে কোনোমতে একটা মোটরসাইকেল চলতে পারে। এতে করে যানবাহনগুলোকে খুবই ধীরে চলতে হয়। ফার্মগেট থেকে কাওরানবাজার-বাংলামোটর হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত চলতে গিয়ে ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের আশঙ্কা, শাহবাগ অথবা মতিঝিল পর্যন্ত রাস্তা সরু হলে আরও ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থার কি করা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানান ট্রাফিক পুলিশের একজন উপকমিশনার। তিনি জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ১৫ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, এভাবে আরও দুই বছর কিভাবে যানজট সামাল দিবো তা নিয়ে আমরাও রীতিমতো চিন্তায় আছি।

রাজধানী ঢাকার প্রধান তিনটি সড়ক হলো-বিমানবন্দর-ফার্মগেট-শাহবাগ-জিরোপয়েন্ট-মতিঝিল, পল্টন-বাড্ডা-বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা হয়ে বিমানবন্দর এবং গুলিস্তান থেকে মিরপুর। এই তিনটি সড়কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিমানবন্দর-মতিঝিল সড়কটি। এই সড়ক ‘ভিআইপি সড়ক’ হিসেবে পরিচিত। এই ভিআইপি সড়কই রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ট্রাফিক পুলিশের মতে, ভিআইপি সড়কের কোনো অংশে যানজট সৃষ্টি হলে এর প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানীতে। এ ছাড়া ভিআইপি সড়ক দিয়ে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা চলাচল করেন। এর পাশাপাশি এই সড়কে ১১১টি রুটের বাস চলাচল করে।

ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের কারণে বাসের চলার পথ পরিবর্তন করায় বর্তমানে সার্ক ফোয়ারা অতিক্রম করছে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৮০০ প্রাইভেট কার। তাই যানজট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা, যাদের প্রধান বাহন বাসের মতো গণপরিবহন। আগামীতে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যানজটের ভয়াবহ বিস্তৃতি ঘটবে। তাতে যাত্রীদের ভোগান্তি ক্রমেই বাড়তেই থাকবে।

এদিকে, যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে ১৫টি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো, মেট্রোরেল প্রকল্প, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ট্রাফিক বিভাগের মধ্যে মাঠপর্যায়ে সমন্বয় করা, যেসব এলাকায় সড়ক বেশি সরু হয়েছে সেখানে ফুটপাত কেটে ছোট করা, বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে ফেলা, ধুলাবালিতে পরিবেশদূষণ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, মেট্রোরেলের ভারী কাজগুলো সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে করানো। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট বা মোড়গুলোতে নজরদারি করা। এর পাশাপাশি বড় কোনো কাজের আগে গণমাধ্যমের সহায়তায় নগরবাসীকে অবহিত করা।

ভুক্তভোগিদের মতে, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ শুরু হতে না হতেই যেভাবে যানজটের ভোগান্তি বাড়তে শুরু করেছে তাতে যাত্রী, বাস চালক ও বাস মালিক সবাই হতাশ। তাদের মতে, গত কয়েক দিনে রাজধানীতে দুর্ভোগ বেড়েছে ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, খেজুরবাগান, তেজগাঁও, শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্সল্যাবরেটরিসহ আশপাশের এলাকায়। বাসের রুট পরিবর্তন করায় যাত্রীদের ভোগান্তি যেমন বেড়েছে তেমনি বাসের রুটভিত্তিক যাত্রীও কমে গেছে বলে মালিকদের দাবি।কয়েকজন মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রুট পরিবর্তন হওয়ায় গন্তব্যের দূরত্ব বেড়ে গেছে। তাতে জ্বালানী খরচও বেড়েছে। মালিকপক্ষের দাবি, দূরত্ব বাড়াতে শ্রমিকদের খরচও দিতে হচ্ছে বেশি।

মেট্রোরেল প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দূরত্বের মেট্রোরেল বসবে। তাতে ৩৭৭টি পিয়ারের ওপর ৩৭৬টি স্প্যান বসানো হবে। প্যাকেজ (সিপি)-৩, ৪, ৫, ৬ -এই চারটি প্যাকেজে এর কাজ পুরোদমে চলছে। এর মধ্য প্রথম ভাগে প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে রয়েছে আগারগাঁও পর্যন্ত। প্রকল্পের এই অংশের কাজ অনেকটাই দৃশ্যমান। ২০২০ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/187138