১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৭:০৯

চট্টগ্রামে দখলদারদের জেদের আগুন কেড়ে নিলো ৯ প্রাণ

কর্ণফুলী তীরের উচ্ছেদ আভিযানে পড়া ভেড়া মার্কেট বস্তির বসবাসকারীরা বস্তি থেকে চলে যেতে চেয়েছিল ১০-১৫ দিন আগে। কিন্তু অবৈধ দখলদার বস্তির মালিকরা তাদের হুমকি দেয়Ñ চলে যেতে হলে তাদের দুই মাসের ভাড়া দিয়ে যেতে হবে। তখন নি¤œআয়ের এসব বাসিন্দারা আর যেতে পারেননি। গতকাল ভোররাতে নগরীর বাকলিয়া থানার ভেড়া মার্কেট এলাকার ওই বস্তিতে এক ভয়াবহ আগুন কেড়ে নিলো আটকে পড়া ৯ প্রাণ। পুড়ে ছাই হলো দুই শতাধিক বসতঘর ও দোকান। বস্তির হাজারখানেক বাসিন্দা জীবনের শেষ সম্বল, সহায়-সম্পদ হারিয়ে এখন হতবিহ্বল। জীবন্ত দগ্ধ হওয়া আটজন ছিল তিন পরিবারের। তাদের পরিবারে চলছে আহাজারি ও শোকের মাতম।

গতকাল রোববার রাতে যখন বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন এক মেয়েকে কোনোমতে বাইরে এনে অন্য সন্তানদের আনতে জ্বলন্ত ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন ভেড়া মার্কেট বস্তির রহিমা আক্তার (৫০)। কয়েক ঘণ্টা পর ওই ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই মেয়ে নাজমা আক্তার (১৪), নাসরিন আক্তার (৪) ও ছেলে জাকির হোসেনের (৯) লাশ। একই ঘরে থাকা রহিমার এক মেয়ে নারগিস (১০) কোনোমতে প্রাণে বেঁচেছে।

বস্তির প্রবেশমুখের প্রথম বসতি ‘সাত্তার কলোনিতে’ একটি মুদি দোকান করতেন স্থানীয় সুরুজ আলীর স্ত্রী রহিমা। দোকানসংলগ্ন সেমিপাকা ঘরে চার সন্তান নিয়ে থাকতেন রহিমা। সুরুজ আলী আরেক স্ত্রী নিয়ে কাছেই আরেকটি কলোনিতে থাকেন। রহিমার বড় মেয়ে নাজমা ঘরের কাজকর্ম করত। আর জাকির স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ত।

রহিমার ভাসুর ফিরোজ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আগুন লাগার পর রহিমা চিৎকার করছিল আর দরজার তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দরজা ভাঙতে পারেনি। আমার ভাগিনা জাকির দোকানের পেছনের দরজা ভেঙে দিলে ভাতিজি নারগিস সেদিক দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে। জাকির অন্যদের বের করবার চেষ্টা করতে গিয়ে আর বেরুতে পারেনি।

সাত্তারের কলোনিতে আরো এক পরিবারের দু’জন জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন। এরা হলেন- আয়শা আক্তার (৩৭) ও তার ভাগ্নে সোহাগ (১৮)। এ ছাড়া, আয়শার ১১ বছর বয়সী মেয়ে ঋতু আক্তারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আয়শার ভাই স্থানীয় তেলের দোকানের কর্মচারী মনির হোসেন। আয়শার স্বামী কয়েক বছর আগে মারা যান। দুই শিশু নিয়ে সত্তার কলোনিতে তিনি বসবাস করতেন।

একই কলোনির বাসিন্দা হাসিনা আক্তারও (৩৭) মারা গেছেন। তার স্বামী সামশু মিয়া চটের বস্তার দোকানের কর্মচারী। এ ছাড়া, উদ্ধার হওয়া ৯ লাশের মধ্যে আরেকজনের পরিচয় মেলেনি। লাশটি নিহত আয়শা আক্তারের নিখোঁজ মেয়ে ঋতুর কি-না সেটা নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, মোট নয়জনের লাশ তারা উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে একজনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। লাশটি এতটাই পুড়ে গেছে যে নারী না পুরুষ তাও বোঝা যাচ্ছে না।

তিনি জানান, রাত সাড়ে ৩টায় তারা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পান। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের ১০টি গাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে ভোর সোয়া ৪টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। মাত্র ৪৫ মিনিটের আগুনে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। মারা গেছেন ৯ জন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বস্তি ঘরের কাঠামো ও জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বিলাপ করে কাঁদছে। নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের কান্নায় পুরো এলাকার আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো আমরা জানি না। এটা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট কিংবা রান্নার চুলা থেকে হতে পারে। অথবা অন্য কোনো উৎস থেকেও হতে পারে। আমরা এটা তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্্েরটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছি। তারা তদন্ত করে দেখবে। নিহতদের দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী মেরিন রোডের উত্তরে রাজাখালী খালের চর দখল করে ২০০০ সালের দিকে গড়ে তোলা হয় বস্তিগুলো। বর্তমানে এই বস্তির নিয়ন্ত্রণে আছেন নগরীর ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি আকতার হোসেন। তার সাথে আছে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী করিম নামে আরো একজন। তারা স্থানীয় সাত্তার, হেলাল, ফরিদ, বেলালসহ কয়েকজনকে এই বস্তির ভাড়াটিয়াদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছেন। এরাই বস্তি থেকে প্রতিমাসে ভাড়া তোলেন।

পুড়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দারা জানান, বস্তিতে ঘরপ্রতি ভাড়া এক-দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। তবে গ্যাসের সংযোগ ছিল না। তারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পুড়ে যাওয়া বস্তিগুলো উচ্ছেদ কার্যক্রমের তৃতীয়পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বস্তিগুলো খালি করার জন্য বাসিন্দাদের পাশাপাশি দখলদারদের কাছেও তথ্য পাঠানো হয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দাররা জানান, নদীর পাড় উচ্ছেদ করতে আমাদের প্রশাসনের লোকজন ঘর ছাড়তে বলেছিল। আমরা চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালা বেলাল এসে হুমকি দেয় যে, আমাদের যেতে হলে দুইমাসের ভাড়া দিয়ে যেতে হবে। তখন আমরা আর যেতে পারিনি। এ না যাওয়াই আমাদের জীবনে কাল হলো।

এ দিকে, রোববার দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা: শাহাদাত হোসেন, স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী নূরুল হকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/389385