১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:০৯

‘গলাকাটা’ মোবাইল ফোন

গ্রাহকদের পাত্তাই দেয় না মোবাইল অপারেটররা

অফার ছিল ৪১ টাকা রিচার্জে ১০ দিন মেয়াদে ২ জিবি ইন্টারনেটের। কিন্তু টাকা রিচার্জের পর ২ জিবি ইন্টারনেট মিললেও মেয়াদ পাওয়া গেল মাত্র দুই দিনের। ভুক্তভোগী পাবনার চাটমোহরের গাজীউর রহমান গ্রামীণফোনের গ্রাহক। গত ২৫ জানুয়ারির ঘটনা এটি। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে (ডিএনসিআরপি) আবেদন করেছেন। এ অধিদপ্তরে এয়ারটেলের গ্রাহক লালবাগের মো. আরিফ হোসেন ভূঁইয়ার অভিযোগ, তিনি তাঁর বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৩ ডিসেম্বর ১১৭ টাকা রিচার্জ করেন। কিন্তু তাঁর অনুমতি ছাড়াই এয়ারটেল তাদের ইচ্ছামতো ইন্টারনেট বান্ডেল দেয় এবং ওই টাকা নিয়ে নেয়। আরিফ হোসেন ভূঁইয়ার আরো অভিযোগ, এর আগেও এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে এবং বিষয়টি এয়ারটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও প্রতিকার পাননি।

রবির গ্রাহক চট্টগ্রামের হালিশহরের জাহিদুল ইসলামের অভিযোগ, তিনি অননেট ও অফনেট পার্থক্য তুলে দেওয়ার এবং এর সঙ্গে সঙ্গে ‘এফএনএফ’-এ কম টাকায় কথা বলার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানতেন না। গত ২৪ জানুয়ারি রবির ওয়েবসাইটে ‘এফএনএফ’-এর অফার দেখেই তিনি ৪০ টাকা রিচার্জ করেন এবং নিজের ‘এফএনএফ’ পার্টনারের সঙ্গে কথা বলার পর লক্ষ করেন, অতিরিক্ত টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। রবির কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলে সেখান থেকে তাঁকে জানানো হয়, কয়েক মাস আগেই ‘এফএনএফ’ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী এ গ্রাহকের প্রশ্ন, বন্ধ হয়ে গেলে কেন গ্রাহকদের তা জানানো হয়নি। কেন রবির ওয়বসাইটে ওই অফারের প্রচার বহাল থাকল। জাহিদুল তাঁর অভিযোগের সঙ্গে ওই অফার প্রচারের স্ক্রিনশটও যুক্ত করেছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে এ ধরনের অভিযোগ প্রচুর। কিন্তু অন্যান্য খাতের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু থাকলেও মোবাইল ফোন গ্রাহকদের ‘ভোক্তা অধিকার’ প্রায় ২১ মাস ধরে স্থগিত। আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তাদের অভিযোগের নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভুক্তভোগীদের জানিয়ে দিচ্ছেন, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় আমাদের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। এ সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ২৮ মে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের পর থেকে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ৮৪৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আর আপাতত প্রতিকার মিলবে না—এই তথ্য জানার পর অভিযোগপত্র জমা দেননি এর কয়েক গুণ গ্রাহক।

গত সোমবার ডিএনসিআরপিতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক (গবেষণাগার উপবিভাগ) শাহীন আরা মমতাজ ও সহকারী পরিচালক (তদন্ত ) মো. মাসুদ আরেফিনের সঙ্গে আলোচনায় এসব তথ্য জানা যায়। তাঁরা জানান, মোবাইল অপারেটরদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে দুইটি রিট হয়েছে। রিট দুটি কজ লিস্টে (দৈনন্দিন কার্যতালিকা) না আসায় শুনানি শুরু হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ বা ক্যাব-এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বিষয়টি সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্রাহকদের স্বার্থে এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি শুরু হলে আমরা পক্ষ হতে চাই। মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক সেবার অনেক অভিযোগ রয়েছে। অনেকে এর শিকার হচ্ছে।’ দুদকের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘কিন্তু বাড়তি দুর্ভোগের আশঙ্কায় সবাই অভিযোগও করে না। আমাদের প্রত্যাশা মহামান্য আদালত এর দ্রুত নিষ্পত্তি করবেন।’

যে ব্যবস্থা নিয়েছিল ডিএনসিআরপি : ২০১৭ সালের প্রথম দিকে গ্রাহকদের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবিকে জরিমানা করে ডিএনসিআরপি। রবিকে জরিমানা করা হয় একাধিকবার। মো. রুবেল মিয়া নামের এক গ্রাহকের অভিযোগের পর শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবি আজিয়াটাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। রুবেলের অভিযোগ ও প্রশ্ন ছিল : রবি অফারে বলা হয়েছিল, ৭৪৬ টাকা রিচার্জ করলে আনলিমিটেড ১৬ জিবি ইন্টারনেট পাওয়া যাবে। কিন্তু মেয়াদ ৩০ দিন। যে অফারের মেয়াদ ৩০ দিন সেটি কী করে আনলিমিটেড হয়?

এরপর বিজ্ঞাপনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা না দেওয়ার কারণে আনিসুল হাই নামে রবির এক গ্রাহক ভোক্তা অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ে প্রতারণার অভিযোগ করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রবিকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই বছরের এপ্রিলে তিন গ্রাহকের পৃথক তিন অভিযোগের ভিত্তিতে রবিকে চার লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গ্রাহক মো. সাইফুল রশীদ শাফিন অভিযোগ করেন, ভ্যাটসহ ২৮ টাকায় ৫০ এমবি ইন্টারনেট ডাটার অফার দেওয়া হয়, একটি লিংকে গেলে সারা দিন বাংলা নাটক দেখা যাবে। কিন্তু তিনি ওই লিংকে গিয়ে কোনো নাটক দেখতে পাননি। এ অভিযোগে রবিকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সোহাগ নামে আরেক অভিযোগকারী ভোক্তা অধিদপ্তরকে জানান, ৯৮ টাকা রিচার্জে ২৮ দিনের মেয়াদে রবির দেড় জিবি ইন্টারনেটের অফার তিনি গ্রহণ করেন। কিন্তু রিচার্জ করার পর তাঁকে দেওয়া হয় এক জিবি ইন্টারনেট। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৪৪ ও ৪৫ ধারায় রবিকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

আল-আমিন নামে আরেকজন অভিযোগ করেন, তিনি প্রতিদিন দুই টাকার বিনিময়ে হেলথ টিপস নামে একটি ভ্যাস সার্ভিস নেন। সার্ভিসটি বন্ধ করতে গেলে নির্ধারিত শর্টকোড দিলেও তা বন্ধ হয়নি। সার্ভিসটি চালু থাকার কারণে তাঁর মোবাইল ব্যালান্স থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। এতে তিনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ অভিযোগে রবিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সব শেষ ওই বছরের ৪ মে সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. জাকারিয়া খানের অভিযোগে রবিকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জাকারিয়ার অভিযোগ ছিল, ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল ইন্টারনেট অফারের একটি মেসেজ দেওয়া হয়। যাতে লেখা ছিল—২৭ টাকা রিচার্জে সাত দিনের মেয়াদে ৪০০ মেগাবাইট (এমবি) ইন্টারনেট দেওয়া হবে। কিন্তু দেওয়া হয় ৩০০ এমবি।

গ্রামীণফোনকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয় আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিক নামের এক গ্রাহকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর আমি ‘দারুণ ঈদ অফার’ নামের ২৮ দিন মেয়াদি এক জিবির সঙ্গে দুই জিবি ফ্রি একটি অফার কিনি। ভ্যাটসহ যার মূল্য ২৭৫ টাকা বলা হয়েছিল। কিন্তু অফারটি গ্রহণ করলে ৩২৫ টাকা ৭৪ পয়সা নিয়ে নেয় গ্রামীণফোন। পরে একটি এসএমএসের মাধ্যমে তাঁকে জানানো হয় সাত দিনের মেয়াদে ফ্রি দুই জিবি ডেটা দেওয়া হয়েছে এবং এটি ব্যবহার করা যাবে রাত ২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। কিন্তু অফারের এসএমএসে এই শর্তের বিষয় উল্লেখ ছিল না।’

২০১৭ সালের ১৯ মার্চ বাংলালিংককে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় আহম্মদ আলী মিনু নামের এক গ্রাহকের অভিযোগে। মিনু অভিযোগ করেন, বাংলালিংকের গ্রাহকসেবা নম্বরে কল করলে কোনো সেবা না দিয়েই এক ঘণ্টা ২৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড ধরে রিং বাজতে থাকে। কেউ কল রিসিভ না করলেও তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৪ টাকা ৭৯ পয়সা চার্জ কাটা হয়। কিন্তু এর কোনো সদুত্তর বাংলালিংক তাঁকে দেয়নি।

বিটিআরসি নির্দেশনা কার্যকর হয়নি : ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে মোবাইল সেবা বিষয়ে যে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়, তাতে গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, অপারেটররা এত বেশি প্যাকেজ ও প্রমোশনাল অফার দিচ্ছে যা বাছাই করা কঠিন। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের প্রতারিত হতে হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের একসঙ্গে ২০টি রেগুলার অফার এবং ১৫টি প্রমোশনাল অফারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারির অপর এক নির্দেশনায় বলা হয়, প্যাকেজ/বান্ডেল/ অফারের সর্বোচ্চ সংখ্যা পরে নির্ধারণ করে জানানো হবে।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিটিআরসিতে গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণের জন্য ১০০ নম্বরের একটি হটলাইন চালু রয়েছে। কিন্তু সেখানে অভিযোগ গ্রহণ করা হলেও তেমন প্রতিকার মেলে না।

মোবাইল অপারেটরদের বক্তব্য : সার্বিক এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মোবাইল অপারেটরদের পক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেও কেউ নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁরা এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় অ্যামটবের কাছে কালের কণ্ঠ’র প্রশ্ন ছিল, ‘মোবাইল অপারেটররা ভোক্তা অধিকার সংক্ষরণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে উচ্চ আদালতে যে রিট করেছে, তার পেছনে কী যুক্তি ছিল বা কী কারণে এই রিট করা হয়। আর সরকার গ্রাহকদের জন্য প্যাকেজের সংখ্যা কমিয়ে আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়ে অপারেটরদের অবস্থান কী?’

রিট সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে গতকাল বুধবার অ্যামটব লিখিতভাবে জানায়, ‘টেলিকম একটি উচ্চপ্রযুক্তিসম্পন্ন খাত এবং একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ—বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই আমরা মহামান্য উচ্চ আদালতের কাছে টেলিকম সেবায় অভিযোগ দায়ের সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা (গাইডলাইন) প্রদান করার জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার আশা করি উচ্চ আদালত শিগগিরই আমাদের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করবেন।’

আর প্যাকেজ সংক্রান্ত প্রশ্নে অ্যামটবের বক্তব্য, ‘মোবাইল অপারেটররা সব সময় গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ও সেবা প্রদান করে এবং তা কতটা সরল করা যায় তা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।’

মন্ত্রী যা বললেন : যোগাযোগ করা হলে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্যাকেজ সংখ্যা সীমিত করার জন্য আমার নির্দেশনা ছিল। ওরা (অপারেটররা) ওদের স্বার্থের পক্ষে তো বলবেই। কিন্তু নানা ধরনের প্যাকেজ গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমি ফোনে কথা বলব তার জন্য ১০০ অপশন কার স্বার্থে? মোবাইল অপারেটরদের শত শত প্যাকেজ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো কমাতে হবে, সহজ-সরল করতে হবে। আগামী মাসেই এটা করা হবে। আগে ঘণ্টা মেয়াদে প্যাকেজ ছিল। এখন সর্বনিম্ন তিন দিন করা হয়েছে। এটাও সাত দিন হবে। এসব বিষয়ে কোনো ছাড়া দেওয়া হবে না।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/02/14/737061