রাজশাহী : নিত্য-নতুন চর জেগে ভরাট হয়ে চলেছে পদ্মার বুক। গতকাল রাজশাহী পদ্মার দৃশ্য। ছবি : সোহরাব হোসেন সৌরভ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭

ভরাট হয়ে চলেছে পদ্মার বুক ॥ ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে গভীরতা ও প্রশস্ততা

# নদীর উৎসের দিকেই ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হয়
# পদ্মায় মাত্র ১০ ভাগ পানি প্রবাহিত হতে পারে
# গঙ্গা-পদ্মায় পানির উচ্চতা কমেছে ১৮ মিটার পর্যন্ত
# নদীর প্রশস্ততা কমেছে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত
সরদার আবদুর রহমান : গঙ্গার উজানে ব্যাপক হারে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে জাগছে নিত্য নতুন চর। এর ফলে প্রতিবছর এই নদী তার স্বাভাবিক চরিত্র ও প্রবণতা হারিয়ে ফেলছে। গত চার দশকে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে জেগে উঠা চরগুলো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে এসব চরে পলি পড়ে ফল-ফসল উৎপাদনের উপযোগী হয়ে উঠছে। এখন নদীতে মাছ চাষের বদলে ফসল উৎপাদন আর বাগান সৃজনের আয়োজন চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্রমতে, ফারাক্কার পর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ১৮৫ কিলোমিটার। দৌলতদিয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে ২৮০ কিলোমিটার। পাউবো’র হিসেবে চার দশক আগেও আরিচার কাছে পদ্মা নদীর প্রশস্ততা ছিলো ১৫ কিলোমিটার। তা সংকীর্ণ হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫ কিলোমিটারেরও কমে। অন্যদিকে স্রোত না থাকায় লাখ লাখ টন বালি পড়ছে নদীর বুকে। সেগুলো পলি পড়ে জমিতে পরিণত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে গঙ্গা-পদ্মায় এযাবত পানির উচ্চতা কমেছে ১৮ মিটার পর্যন্ত। এদিকে পদ্মায় পানি না থাকায় পাগলা, বড়াল, গড়াই, মাথাভাঙ্গা প্রভৃতিও মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এসঙ্গে বিলুপ্তির জন্য অপেক্ষা করছে পদ্মার স্রোতনির্ভর আরো বহু নদী ও খাল-বিল। এসব জলাধারের পাশে বাস করা মানুষেরও কষ্ট বেড়েছে।
উজানে অসংখ্য প্রকল্প
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা মরে যাওয়ার জন্য কেবলই ফারাক্কা বাঁধের কথা বলা হয় এবং ফারাক্কা দিয়ে বাংলাদেশের তথাকথিত ‘নায্য হিস্যা’ না পাওয়ার কথা বলা হয়। আর প্রতিপক্ষ কেবলই বলে ফারাক্কা পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি না আসায় বাংলাদেশকে পানি দেওয়া সম্ভব হয় না। দৃশ্যত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী পানির একটি ভাগ পায় বাংলাদেশ। ফারাক্কায় পানি কম থাকলে বাংলাদেশও কম পায়। বর্ষায় পানির কোনো অভাব নেই, ভারতও তখন ফারাক্কা ব্যারাজের সব দরজা খুলে দেয়। সূত্রমতে, বাংলাদেশের চারজন প্রতিনিধি ফারাক্কা ব্যারাজে নিয়োজিত থাকেন। যেটুকু পানি বাংলাদেশকে দেয়ার কথা ভারত তা দিচ্ছে কি না, তা দেখাই তাঁদের দায়িত্ব। দৈনিক কতোটুকু পানি দেয়ার কথা, বাস্তবে কতোটুকু পানি বাংলাদেশ পায়, সেই হিসাব পদ্মার প্রবাহনির্ভর মানুষেরা জানেন না। তারা কেবলই জানেন ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশ ঠিকমতো পানি পাচ্ছে না। যদিও যৌথ নদী কমিশনের কাগুজে তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী ঠিকই পানি পেয়ে চলেছে। কিন্তু ফারাক্কায় পানি না আসার মূল বাধা-প্রতিবন্ধকতার কথা উচ্চারিত হয় না। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শুধু ফারাক্কা বাঁধই নয়- উজানে গঙ্গার পানি বহুবিধ উপায়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছ। ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। এর ফলে একদিকে হুগলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কোলকাতা পোর্ট সারাবছর সচল থাকবে এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে। এখানেই শেষ নয়, ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি রুপি। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে কমে যাবে তা পানির মতোই পরিষ্কার। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি স্বত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘ন্যায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ। এছাড়াও নদীসদৃশ বেশ কয়েকটি ক্যানেল প্রকল্প দিয়েও সারা বছর পানি প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে। ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।
ফল-ফসলের চাষবাস
পদ্মায় যেখানে চাষ হওয়ার কথা ইলিশের, নানা সুস্বাদু মাছের। তার উল্টো পরিস্থিতি পদ্মার বাসিন্দাদের। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহীর বাঘায় মূল পদ্মা নদীতে এখন আর পর্যাপ্ত পানি জমে থাকে না। মাইলের পর মাইলজুড়ে ধূ ধূ চর আর বালি। এই এলাকার মানুষ ভুলে গেছে সুস্বাদু ইলিশ আর মিঠা পানির মাছের কথা। বাঁচার তাগিদে মানুষ নদীর চরে নানা ফসল আবাদের পাশাপাশি তৈরি করতে শুরু করেছে কুল ও আমবাগান। চরবাসীরা জানান, বন্যা অথবা পানির অভাবে কোনো কোনো বছর তারা ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। ফলে নদী ও চর এলাকার কৃষকরা এখন প্রলুব্ধ হচ্ছেন আম এবং কুলচাষের দিকে। অনেকেই মাটির ঢিপি বানিয়ে সেখানে রোপণ করেন আমের চারা। এভাবেই তৈরি হতে থাকে আমের বাগান। অনুরূপভাবে তৈরি হয় কুল বাগান। গোদাগাড়ী উপজেলার ৩০ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে পদ্মা নদী। নাব্যতা কমে যাওয়ায় নদীর বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠায় পদ্মা বিভক্ত হয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানান, বর্ষা মওসুমে পানি ভরে থাকলেও নদীর তীরে ভাঙন ও বন্যা দেখা দেয়। আর শুষ্ক মওসুমে নদীর বুকে ছোট-বড় মিলে অসংখ্য চর জেগে উঠে। নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। মানুষ হাঁটু পানির মধ্যে নদী পার হয়। চর জেগে উঠায় তিন ভাগে বিভক্ত নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার এমন অবস্থার কারণে চর ও বরেন্দ্র এলাকায় বৈরি আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মওসুমে এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনিভাবে এর বিরূপ প্রভাব কৃষিতে পড়ায় মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের উৎপাদনও কমে গেছে ব্যাপকভাবে।
নিম্নগামী পানির ভূ-স্তর
অন্যদিকে চলতি বছরেও পদ্মায় পানির অভাবে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভূ-গর্ভে পানির স্তর ৩৫ ফুট থেকে ১১০ ফুট পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। এতে চাষাবাদ ও মাছ চাষ হুমকির মুখে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা জানান। পদ্মায় নদীর তলদেশ শুকিয়ে রাজশাহী নগরীর পাশে নদীর মূল ধারা থেকে দেড় কিলোমিটার চওড়া এবং ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ চর পড়েছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সদ্য বন্যা মওসুম শেষ হওয়ার পর অতি দ্রুত পানি নেমে যায় উৎসের দিকে। অন্যদিকে উজান থেকে প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহ না পৌঁছানোয় শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই পদ্মায় পানি প্রবাহ বিপুল মাত্রায় কমে যেতে শুরু করেছে। স্রোত না থাকায় লাখ লাখ টন পলি এসে পড়ছে পদ্মার বুকে। বছরে পদ্মায় তিন মাস পানি থাকলেও নয় মাসই পানি থাকে নদীর তলায়। এর ফলে নদীর বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে জেগে উঠে চর। পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ায় এর সাথে সংযুক্ত ২৫টি নদীও এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ অভিমত
পদ্মার এই পরিস্থিতির নেপথ্যে ভারতের নির্বিচারে পানি আগ্রাসন দায়ী বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞ হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী। তাঁর মতে, উৎস ও উজান থেকে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পরিমাণ পানি এসে পৌঁছাতে না পারার কারণে স্বাভাবিক প্রবাহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক পানি থেকে বঞ্চিত থাকছে। বিষয়টি যেন দিনে দিনে গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। তিনি ফারাক্কার আরো উজানে নির্মিত বাঁধ ও খননকৃত খাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের জন্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। এই সঙ্গে বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে বাস্তবমুখি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের দাবি করেন তিনি।

http://www.dailysangram.com/post/365012