১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:০৪

তালগোল আসলে জীবনদর্শনে

তিন তরুণ বন্ধুকে অপহরণ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে গাজীপুর এবং টাঙ্গাইল জেলার দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ৭ ফেব্রুয়ারি কালিয়াকৈর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল্লাহ আল মামুন ও মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপহরণ ও মুক্তিপণের কথা স্বীকার করেছেন অভিযুক্ত দুই পুলিশ সদস্য। তবে একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গত বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রাজধানীর বাণিজ্য মেলার উদ্দেশে রওয়ানা হন পাঁচ বন্ধু। বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সূত্রাপুর এলাকায় শিলা-বৃষ্টি ফিলিং স্টেশনে যান গ্যাস নিতে। গ্যাস নেয়ার সময় তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল রহমান গাড়ি থেকে নেমে পাশের দোকানে চা খেতে যান। বাকিরা গাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এ সময় দু’টি গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হন এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন ও মুসফিকুর রহমান। তাঁরা সাদা পোশাকে ছিলেন। মুসফিকুরের মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকের আরও কয়েকজন লোক ছিলেন। ওদের চার-পাঁচজন রায়হানসহ তিন বন্ধুকে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে মাইক্রোবাসে তোলেন। রায়হান বলেন, তাঁদের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দেওড়া এলাকায় নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁদের মুক্তি দেয়ার বিনিময়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। দাবি করা টাকা না দিলে ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। পরে বেশ কিছু সময় তাঁদের সঙ্গে টাকা নিয়ে দরকষাকষি হয়। এক পর্যায়ে দুই এএসআই ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানান। এদিকে অপহরণের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া দুই বন্ধু তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল মুঠোফোনে পুরো ঘটনা কালিয়াকৈর থানার পুলিশ এবং অপহৃত তিন বন্ধুর পরিবারের সদস্যদের জানান। অভিযোগ জানার পর কালিয়াকৈর থানা থেকে একটি দলকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। তারা প্রাথমিকভাবে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হন যে, এএসআই মামুন ও মুসফিকুর এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত।

অপহরণের সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার এই যে ঘটনা, তা কিন্তু নতুন নয়। আগেও এ ধরনের ঘটনার সাথে পুলিশকে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। অন্য ধরনের অপরাধের সাথেও কিছু পুলিশ সদস্যকে যুক্ত থাকতে দেখা গেছে। আবার অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও আইনের আওতায় আনার কাজটিও কিন্তু পুলিশ সদস্যরাই করেছেন। ফলে আমরা পেলাম দু’টি চিত্র। কেউ দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে সঙ্গত কাজ করছেন। আবার কেউ নিজেই দুষ্ট হয়ে পুলিশের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট করছেন। এখানে বিবেচনার বিষয় হলো, রাষ্ট্র ও জনগণ কোন ধরনের পুলিশ চায়? কাক্সিক্ষত পুলিশের পরিচয়তো সবার জানা আছে? জানা আছে রাষ্ট্র এবং পুলিশ প্রশাসনেরও। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে বাংলাদেশ পৌঁছতে পারছে না কেন? সংকট কোথায়? সংকটের গভীরে গেলে লক্ষ্য করা যাবে ক্ষমতার স্বার্থে, দলীয় স্বার্থে, আরও কতিপয় ক্ষুদ্রস্বার্থে আমরা যথাকাজ যথাভাবে করতে পারছি না। নৈতিক এমন অবক্ষয় শুধু বাংলাদেশের সংকট নয়, সংকট বর্তমান সভ্যতার। আমরা তো চাই, সভ্যতার এই সংকট মোচনে বাংলাদেশ সৃষ্টি করুক অনন্য উদাহরণ।

সভ্যতার দায় যাদের ঘাড়ে তাদের চালচিত্রটা এখন কেমন?
‘রাত পোহাতেই সুর পাল্টালেন ট্রাম্প’- এমন শিরোনাম থেকে ট্রাম্পের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার তার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে প্রতিহিংসা, প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ ভুলে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১২ ঘণ্টা যেতে না যেতেই সেই আহ্বান ভুলে কংগ্রেসের ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধে নেমে পড়েছেন তিনি। এমন চিত্রে উপলব্ধি করা যায়, কথা ও কাজে মিল রাখার যে নৈতিকতা তা রক্ষায় তিনি তেমন উৎসাহী নন।

ট্রাম্পের ক্ষোভের মূল কারণ কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের গোয়েন্দা বিষয়ক কমিটির প্রধান অ্যাডাম শিফ। এই ডেমোক্র্যাট নেতা ট্রাম্পের আর্থিক লেনদেন নিয়ে নতুন তদন্ত শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ট্রাম্প আগেই জানিয়েছিলেন তার এবং পরিবারের আর্থিক বিষয়ে কোনো তদন্ত সহ্য করবেন না তিনি। প্রথম দুই বছর রিপাবলিকান দল কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এ ব্যাপারে কোন সমস্যা হয়নি। এখন অবস্থা বদলে গেছে। অ্যাডাম শিফ গত বুধবার বলেন, শুধু রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক লেনদেন নয়, অন্য যে কোনো বিদেশি সরকার বা সংস্থার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়েও কমিটি তদন্ত করবে। ট্রাম্প অথবা তার পরিবার অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, এ সংক্রান্ত সব প্রতিবেদন কমিটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। শিফ আরো বলেন, ট্রাম্পের কার্যকলাপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিপদগ্রস্ত হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা এই কমিটির এখতিয়ারে পড়ে। এমন অবস্থায় গত বুধবার ট্রাম্প সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এ্যাডাম শিফকে একজন ‘ভাড়াটে রাজনীতিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, এই লোকটার একমাত্র লক্ষ্য নিজের জন্য নাম কেনা। আর গোয়েন্দা কমিটির তদন্তের নতুন ঘোষণা প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, এই তদন্তের একটাই লক্ষ্য, দেশের প্রেসিডেন্টকে হয়রানি করা।’

তদন্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি চান না তার এবং পরিবারের আর্থিক বিষয়ে কোন তদন্ত হোক। তদন্ত এখনতো শুধু আর্থিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না, ট্রাম্পের কার্যকলাপে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিপদগ্রস্ত হয়েছে কিনা সেই বিষয়টাও যুক্ত হচ্ছে। একজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এসব বিষয়ে তদন্ত জনগণের জন্য বেশ উদ্বেগের বিষয়। এর আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন কেলেংকারি ও মিথ্যা বলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে। আর কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এতোসব অভিযোগ ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নৈতিক অবক্ষয়ের মাত্রা কি বেড়েই চলেছে?

বর্তমান সভ্যতায়, বিশ্বব্যবস্থায় মানুষ যেন স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে ভুলে গেছে। অতিকথন তো আছেই, ভুল কথারও ছড়াছড়ি। আর অন্যায় ও অমানবিক কর্মকা-ের তো অভাব নেই। সাধারণ পুলিশ থেকে প্রেসিডেন্ট, রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতা- সবাই অনেক কিছু হয়ে গেলেও মানুষ হতে যেন ভুলে গেছেন। এমন বাতাবরণে এখন এক অদ্ভুত দর্শনে মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইছেন সন্তান।

বিবিসি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতে রাফায়েল স্যামুয়েল নামের এক যুবক মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। জন্ম দেওয়ার আগে মা-বাবা কেন তার অনুমতি নিলেন না- এই অভিযোগে তিনি মামলা করবেন। রাফায়েল মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। বয়স ২৭ বছর। পেশায় ব্যবসায়ী তিনি। তার ভাষ্য, সন্তানকে পৃথিবীতে আনাটাই ভুল। কারণ, মানুষকে জীবনভর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যুবকের যুক্তি, ‘যেহেতু জন্মের সময় আমাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি, কাজেই জীবন ধারণের জন্য আমাদের অর্থ দিতে হবে।’ কম যান না রাফায়েলের মা-বাবাও। পেশায় তারা দু’জনই আইনজীবী। এক বিবৃতিতে রাফায়েলের মা কবিতা করনাদ স্যামুয়েল বলেন, ‘আমাকে অবশ্যই আমার সন্তানের হঠকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। জন্মের আগে সন্তানের কাছ থেকে কীভাবে অনুমতি নিতে হয় তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা যদি রাফায়েল দিতে পারে, তাহলে আমি আমার ভুল স্বীকার করে নেব।’

তালগোল বেধেছে আসলে রাফায়েলের জীবন দর্শনে। তিনি প্রজননবিরোধী (অ্যান্টি-নাটালিজম) দর্শনে বিশ্বাসী। এই দর্শন মতে, জীবন দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। কাজেই মানুষের উচিত এখনই সন্তান জন্ম বন্ধ করে দেওয়া। রাফায়েলের মতে, ‘সন্তান জন্ম বন্ধ করে দিলে এক সময় এই পৃথিবী থেকে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যা এই গ্রহের বাকি বাসিন্দাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। মানুষ বিলুপ্ত হলে এই পৃথিবী ও বাকি প্রাণীদের জীবন সুন্দর হবে।’ রাফায়েলের দর্শন বেশ অদ্ভুত। তিনি বাকি প্রাণীদের সুন্দর জীবনের কথা ভাবতে পারলেও শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের সুন্দর জীবনের কথা ভাবতে পারেননি। রাফায়েল আসলে হতাশাগ্রস্ত এবং বিভ্রান্ত। এখন উপলব্ধি করা যায়, কেন ধর্মে হতাশ হওয়া নিষিদ্ধ। অনেক রাষ্ট্রপ্রধানও এখন আবোল-তাবোল বলছেন। তাদের সবারই এখন ধর্মগ্রন্থ পাঠে মনোযোগী হওয়া উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/365010-