১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১১:৪৯

বিআরডিবির বেহালদশা

বেতন না পেয়ে কর্মীর আত্মহত্যা; না খেয়ে আছে হাজার হাজার পরিবার; অনেকে আবার আঙুল ফুলে কলাগাছ

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। অসহায় ও মানবেতর অবস্থায় তাদের দিন কাটছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, স্বজনপ্রীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নানা অনিয়মের বোঝা নিচের সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বয়ে বেড়াচ্ছেন। এ দিকে ঠিকমতো বেতন-ভাতা না পাওয়া ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ সহ্য করতে না পেরে গত শুক্রবার ফেনীতে এক মাঠকর্মী আত্মহত্যা করেছেন।

ফেনীতে মারা যাওয়া বিআরডিবি কর্মীর নাম আনোয়ারা বেগম (৫৩)। ফেনীর ফুলগাজী শাখায় পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিতে (পদাবিক) কর্মরত ছিলেন তিনি। একদিকে বেতন বন্ধ, অপর দিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ। সব মিলিয়ে আনোয়ারা ছিলেন চরম হতাশাগ্রস্ত। শেষ পর্যন্ত গত শুক্রবার বিকেলে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে তার পরিবার দাবি করেছে। তার বাসা থেকে দু’টি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি ২৮ বছর ধরে বিআরডিবিতে কর্মরত ছিলেন। তার পরিবার জানায়, এভাবে ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাও করা যায়নি। টাকার অভাবে পরিবারের লোকজন না খেয়ে থেকেছেন। এরপর ক্রমাগত চাপ ছিল অফিসের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা অফিসে কর্মরত এক কর্মী বলেছেন, আনোয়ারা বেগমের পরিণতি অনেকের ভাগ্যেই জুটতে পারে। মাসের পর মাস এভাবে বেতন না পেয়ে অনেকেই এখন দিশেহারা। তাদের সংসার চলছে না। সন্তানদের শিক্ষা বন্ধ। আর এদের অনেকেই রয়েছেন, যারা দুই যুগেরও বেশি বিভিন্ন প্রকল্পে বিআরডিবিতে কাজ করছেন। এই বয়সে অন্য কোথাও চাকরি করবেন তারও সুযোগ নেই। শূন্য হাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেকে চলে গেছেন।

জানা গেছে, এই কর্মীরা তাদের বয়সের মূল সময়টাই বিআরডিবিকে দিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে হওয়ায় তাদের সরকারের রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর যেসব প্রকল্প ছিল তার অনেকগুলোই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো চলছে ঢিমেতালে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, স্বজনপ্রীতি, দূরদর্শিতার অভাব, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

বিআরডিবির সিবিএ সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কয়েকটি প্রজেক্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। কিছু কিছু প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ওই সব প্রজেক্টের কর্মীরা কী করবেন তার কোনো নির্দেশনা নেই। বেতন না পেয়ে তাদের ত্রাহী অবস্থা। এমন প্রায় আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন বলে আব্দুর রাজ্জাক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এসব কর্মীর রাজস্ব খাতে নেয়ার দাবি অনেক পুরনো। তাদের এই দাবির ব্যাপারে তাদের পক্ষে আদালতেরও রায় রয়েছে। কিন্তু সবকিছুই উপেক্ষিত। পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু নিয়োগ নেই।

কয়েকজন কর্মচারী বলেছেন, শূন্যপদে তারা নিয়োগ না পেলেও কর্তারা ঠিকই এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তা ছিলেন, যারা এই শূন্য পদে তাদের আত্মীয়স্বজনের চাকরি দিয়ে গেছেন। অনেকে দুর্নীতি করে টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন। কিন্তু বছরের পর বছর তারা এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী থাকলেও রাজস্ব খাতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বিআরডিবির সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম বলেন, এর দায় কর্তৃপক্ষের। তাদের কারণেই বেতন পাচ্ছেন না কর্মচারীরা। বড় বড় কর্তারা চান না এই প্রতিষ্ঠানটি বাঁচুক। এর কর্মীরা বাঁচুক। তিনি বলেন, বিআরডিবি একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। অথচ তার কর্মী মারা গেলে কাফনের কাপড় কেনারও টাকা থাকে না। কর্র্তৃপক্ষ বলে, আয় থেকে বেতন নিবে। কিন্তু ফান্ড না দিলে আয় হবে কোত্থেকে?

কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন, ৮-১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন না থাকলেও অনেকে এই প্রতিষ্ঠান দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। নানাভাবে তারা সরকারের টাকা তছরুপ করছেন। আয়ের সাথে তাদের ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি নেই। এমন একজন মহাপরিচালক ছিলেন যিনি নিজের আত্মীয়স্বজন ও এলাকার লোক দিয়ে বিআরডিবি পূর্ণ করে গেছেন। এভাবে অনেকেই নানা অনিয়ম করেছেন।

এ দিকে বিআরডিবির এই বেহাল দশা সম্পর্কে জানতে গতকাল কয়েক দফা ফোন দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মওদুদুর রশিদ সফদারের মোবাইলে। তিনি ফোন ধরে মিটিংয়ে রয়েছেন এবং পরে ফোন দেয়ার জন্য বলেন।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/387343