১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১২:০৮

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

একেএম শামসুদ্দিন

গত এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত যে সংবাদটি দেশব্যাপী মানুষের বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়ে গেছে, সেটি হল, বিনা অপরাধে পাটকল শ্রমিক জাহালমের তিন বছর কারাভোগ। দুর্নীতি দমন কমিশনের নিতান্ত অবহেলা ও ভুলের কারণে জাহালমের জীবনে যে ভয়াবহ বিপদ নেমে এসেছিল, ভুক্তভোগী হিসেবে তা শুধু জাহালম ও তার পরিবারই বলতে পারবেন বিগত তিন বছর তাদের কী রকম দুর্বিষহ সময় কেটেছে।


কিছুদিন আগেও জাহালম একটি অপরিচিত নাম ছিল। কিন্তু অমানুষিক যন্ত্রণা নিয়ে কারান্তরালের তিন বছরের জীবন তাকে জনসম্মুখে পরিচিত করে তুলেছে। এটি তার জন্য কোনো সুখসংবাদ নয়, বরং এটি তার একখণ্ড বেদনাবহ জীবনের করুণ চিত্র। টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবড়িয়া গ্রামের মনোয়ারা বেগমের ছোট ছেলে জাহালম সহজ-সরল-শান্ত স্বভাবের একজন নিরীহ প্রকৃতির যুবক। বিবাহিত ও এক কন্যাসন্তানের পিতা।

ছোট্ট একটি সংসারে হয়তো সুখেই তার জীবন কেটে যাচ্ছিল; কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান যে অমানবিক আচরণটি তার সঙ্গে করল, তা সাধারণ মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না। সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়াই তা বলে দেয়। জাহালমের অপরাধ সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত ভয়ংকর অপরাধী আবু সালেকের সঙ্গে তার চেহারার সাদৃশ্য।

২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুদকের চিঠি পেয়ে হাজিরা দিতে গেলে সেখানে উপস্থিত দুদক ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা সবাই মিলে জাহালমকেই আবু সালেক বলে শনাক্ত করেন। ভাবতে অবাক লাগে সোনালী ব্যাংকে তার নামে কোনো হিসাব বা লেনদেন নেই, ইংরেজিতে তিনি স্বাক্ষরও করতে জানেন না, ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরমে আবু সালেকের যে ছবি দেয়া আছে সে ছবিটি তার নয় বলার পরও এতগুলো কর্মকর্তা একযোগে ঘোষণা দিয়ে দিলেন জাহালমই প্রকৃত আবু সালেক! একে একে ৩৩টি মামলাও দিয়ে দিলেন তার নামে? অতঃপর ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি হাতে লোহার কড়া পরিয়ে নির্দ্বিধায় পাঠিয়ে দিলেন কারাগারের অন্তরালে!

জাহালমের ঘটনা জনসম্মুখে জানাজানি হয়ে গেলে দুদক চেয়ারম্যান সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং এ ঘটনার তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারির সংবাদমাধ্যমে যে খবর বেরিয়ে এসেছে তা শুনে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তিনি নাকি বলেছেন, ‘জাহালমকে দুদক গ্রেফতার করেনি। গ্রেফতার করেছে পুলিশ।’

নিরপরাধ জাহালমকে গ্রেফতারের সব আয়োজন সম্পন্ন করে তাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দায়িত্বশীল মহল থেকে যখন অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন আমরা সাধারণ মানুষ হতাশ না হয়ে পারি না। সোনালী ব্যাংকের এ সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলাগুলোর তদন্ত করেছেন দুদকেরই ৯ কর্মকর্তা।

আনুমানিক ছয়-সাত মাস আগে দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালম এ মামলায় নিরপরাধ তা উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও উল্লিখিত ৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দুই ফেব্রুয়ারি শুনানিকালেও আদালত এ জালিয়াতির মামলায় যেসব তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহালমের নামে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চেয়েছেন।

আদালত দুদকের আইনজীবীর কাছে আরও জানতে চান, ‘আপনারা বিষয়টি গত বছরের মে মাসে জেনেছেন, তাহলে এতদিন কী করলেন? তার মুক্তির ব্যবস্থা করেননি কেন? দুদকের মিথ্যা তদন্তের সুযোগ কোথায়?’ দুদকের আইনজীবী আদালতের জিজ্ঞাসার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘জাহালম জালিয়াতির মামলার আসল আসামি নয় জেনে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অতএব আদালত জাহালমকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে দুদকের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে তিনি আরও জানান। এখন প্রশ্ন হল, এমন একটি অঘটন উদ্ঘাটিত হওয়ার পরও কোনো আপত্তি থাকতে পারে কি? মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক, উল্টো ‘পেশাগত দক্ষতা’র জন্য আটজনকে ইতিমধ্যে পদোন্নতিও দেয়া হয়ে গেছে। দায়িত্ব অবহেলার পরও কী করে তাদের পদোন্নতি দেয়া হল এ কথা জিজ্ঞেস করতেই দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘পদোন্নতির সঙ্গে তো দায়িত্বে অবহেলার কোনো সম্পক নেই।’

সংবাদমাধ্যমে দুদক চেয়ারম্যানের এ প্রশ্নের জবাবটা যদি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে তাহলে কি আমাদের মেনে নিতেই হবে, এমন একটি অমার্জিত ঘটনা ঘটালেও তা দায়িত্ব অবহেলার পর্যায়ে পড়ে না কিংবা এমন নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড করার পরও তা পদোন্নতির জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না? এ দেশের নাগরিক হিসেবে জানতে ইচ্ছা হয় এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকর্তারা যখন পদোন্নতি পেয়ে আরও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হবে তখন জাহালমের মতো এ দেশের অভাগা মানুষের কী হবে?

জাহালমের এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দশাসই চেহারা ক্রমেই বেরিয়ে পড়ছে। তাদের এহেন কর্মকাণ্ডে গাফিলতির স্পষ্ট চিত্রটিও ফুটে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বড় বড় অর্থ জালিয়াতির অনেক তদন্তের প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দিব্যি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু-একটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও অধিকাংশ মামলাই এখনও ঝুলে আছে অনাগত দিনের জন্য।

এ প্রসঙ্গে শুনানিকালে আদালতের আরও একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, ‘দুদক যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে এ দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা স্থায়ী রূপ নেবে না।’ সাম্প্র্রতিক সময়ে রাষ্ট্রপরিচালিত ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় চরম ধস নেমেছে। এসব কেলেঙ্কারি থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও মুক্ত নয়। এত কেলেঙ্কারি, আলোচনা-সমালোচনা, তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এসবের বিরুদ্ধে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ফলে বাংলাদেশ আজ দুর্নীতির ধারণাসূচকে বিশ্বের ১৩তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের তুলনায় ৪ ধাপ পিছিয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭তম। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। এসব দুর্নীতির পুরোপুরি ভুক্তভোগী দেশের সাধারণ মানুষ। সম্প্র্রতি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সরকারি দফতর পরিদর্শনে গিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে।

সরকারের কেউ কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলছেন, ‘জিরো না, টলারেন্স হবে মাইনাস।’ এটি একটি অত্যুক্তি মনে হতে পারে; কিন্তু বর্তমান দুর্নীতি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় আছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। তবে এ কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে চাই সবার সহযোগিতা। এ সহযোগিতা শুরু হতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মহলের মধ্য থেকে। এ ছাড়া অতীত ঘটনাবলি মাথায় রেখে ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতার বৃত্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কঠোরভাবে। তাহলেই মুখের উক্তি বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হবে। তা না হলে ক্ষমতাসীনদের এসব উক্তি অতীতের মতোই মুখসর্বস্বই থেকে যাবে।

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাম্প্রতিক সাঁড়াশি অভিযান সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ অভিযানের ফলে বেরিয়ে এসেছে অবিশ্বাস্য সব দুর্নীতির কাহিনী। নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সম্পদের গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। এত অল্প সময়ে নিম্নস্তরের কর্মচারীদের কল্পকাহিনীর মতো অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার ঘটনা শুনে মানুষের ভেতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- ওই খাতের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা না জানি কত সম্পদের মালিক! কারণ মানুষ বিশ্বাস করে ছোটখাটো কর্মচারীরা বড়দের প্রশ্রয় না পেলে এহেন গর্হিত কাজ কোনো অবস্থায়ই সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে না।

স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বিগত পাঁচ বছরে এ খাতের দুর্নীতির হার বেড়েছে বহুগুণে। আমরা মিডিয়ায় দেখেছি, কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক পর্যায়ের কর্তাকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে চাকরিচ্যুত হয়ে চোখের জল ফেলে বাড়ি ফিরে যেতে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের বড় কোনো ভূমিকা আমাদের চোখে পড়েনি।

এতে দেশের মানুষের মনের ভেতর যদি কোনো ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়, তাতে দোষের কিছু দেখি না। ওয়াচডগের ভূমিকা পালনকারী আমাদের এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থান ২০০০-২০০৫ সালের মতো সেই তলানিতেই গিয়ে ঠেকবে।

আশা করি, জাহালমের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে দুদকের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের যে ঘাটতি আছে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক যথেষ্ট স্বাধীন। অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই তাদের। এখন শুধু সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে, ক্ষমতার বলয় কর্তৃক বশীভূত না হয়ে দুর্নীতি দমনে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/142671