৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:২৬

সালেকরা ভেগে যান জাহালমরা জেল খাটেন

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’। আগে একটা এমনই প্রবাদ পড়েছিলাম। মনে আছে নিশ্চয়ই অনেকের। হ্যাঁ, কলাগাছের এখন সত্যই কোনও দাম নেই। কলাগাছ আর কেউ হতে চানও না। অর্থাৎ কলাগাছের মতো কেউ ফুলতে চান না। মোটা হতে চান না সামান্য কলাগাছের ন্যায়। সবাই বটগাছ হতে চান। বরং বটগাছের চাইতেও বেশি। ফুলেফেঁপে খুব দ্রুত হিমালয়ের মতো বিরাট হতে এখন আর অনেকেরই কোনও বাধা নেই। ইচ্ছে করলেই তা প্রায় রাতারাতি হওয়া যাচ্ছে। এমনই খবর প্রিন্ট মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন। দুদক বেচারা কতজনকে ধরবে?

মাত্র ১৫ বছর সময় নিয়েছেন বটগাছ হতে তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারী লিয়াকত। অভাবনীয় সাফল্য তাঁর। হ্যাঁ, ১৬টি কার্গো জাহাজ। আধুনিক মডেলের তিনটি প্রাইভেট কার। শহরের ভাটি লক্ষ্মীপুরে ২৪ কাঠা জমিতে রয়েছে তাঁর বাগানবাড়ি।

ফরিদপুর সদরের টেপাখোলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় লিয়াকতের স্ত্রী লাকির নামেও রয়েছে একটি প্রাসাদসমান বাড়ি। একই এলাকায় ‘মাহি মাহাদ ভিলা’ নামে রয়েছে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। এ বাড়িতে লিয়াকতের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা থাকেন।

ফরিদপুর শহরের বায়তুল আমান এলাকায় লিয়াকতের স্ত্রীর নামে রয়েছে পাঁচ কাঠার আবাসিক প্লট। গোলডাঙ্গির চরে এল এন্ড এমএম নামে রয়েছে একটি ইটভাটা। এর মালিকও লিয়াকত। বড়বোন নাসরিন আখতারের নামে নাজিরপুরে এ এন্ড আর ব্রিকস নামে আরেকটি ইটভাটা রয়েছে।

সি এন্ড বি ঘাটের বাজারে রয়েছে ১৭ শতাংশ জমি ও একটি দোতলা ভবন। শহরতলির আদমপুর এলাকার বেরহমপুর মৌজায় ১৭ বিঘা জমি রয়েছে স্ত্রীর নামে। কে এই লিয়াকত? তিনি হলেন রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী মানে হিসাবরক্ষক। লিয়াকত হোসেন জুয়েল। এমনই খবর চাউর হয়েছে মিডিয়ায়।

হ্যাঁ, একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী কীভাবে এতো দ্রুত বাড়ি, গাড়ি, কার্গো, জায়গাজমি, নিজনামে এবং স্ত্রীর নামে এ বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক কি কলাগাছ হলে চলে? বটবৃক্ষ না হলে কীভাবে হয়? তাই লিয়াকত সাহেব এখন কলাগাছ নন। তিনি বটবৃক্ষ। শত কোটি টাকার মালিক। তবে দুদক লিয়াকতদের খোঁজ পায় না।

আবু সালেক নামের এক চতুর ব্যক্তি ২১ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে জাহালমের নামে ঋণ নিয়ে মেরে দিয়ে ভেগে গেছেন। আর এজন্য বেচারা নিরপরাধ নির্দোষ এক পাটকল শ্রমিক জাহালমকে ৩ বছর জেল খাটতে হলো। অথচ জাহালম সেই তুলনায় কোনও বটবৃক্ষ দূরের কথা, কলাগাছ এমনকি দুর্বাঘাসও নন। কিন্তু এরা গ্রেফতার হন। ধরা খান। বছরের পর বছর জেল খাটেন অন্যের দায় মাথায় নিয়ে। এ কোন অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশ আমার!

শুধু লিয়াকত আর আবু সালেক কেন, জনগণের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে ভেগে যান অনেকেই। ব্যাংকের টাকা খেয়ে ফেলেন অনেক দায়িত্বশীলও। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ধরাকে সরা মনে করেন অনেক জনই। প্রশাসন, পুলিশ বা অন্যকোনও সংস্থার কেউ তাঁদের ধারেকাছে ভেড়ে না। লোম স্পর্শ করতে সক্ষম হয় না। সব দোষ হয় নন্দঘোষদের। সাধারণের রেহাই নেই। চুন থেকে পান খোসলেই আর রক্ষা মেলে না তাদের।

শুধু লিয়াকত কেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরেক হিসাবরক্ষক আফজালের কথা ভুলে গেছেন সব? এইতো মাত্র ক’দিনের কথা। চাকরজীবনের মাত্র ২৭-২৮ বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। লিয়াকত আর আবু সালেক সে তুলনায় চুনোপুঁটি বা কলাগাছই বটে।
জাহালমের নামে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে যে আবু সালেক বিদেশ পালিয়েছেন তাঁকে কারা সহযোগিতা করেছেন? একদিনে এতো টাকা নিশ্চয়ই হাতিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। ক্রমাগত এবং সুদূর পরিকল্পনা মাফিক এতো টাকা তোলা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত নিশ্চয়ই আরও অনেকে রয়েছেন। তাঁরা কারা? কী তাঁদের পরিচয় তা সবার সামনে প্রকাশ করা হোক। কারা এসব কালপ্রিট? এদের চিহ্নিত করা গেলে সব রহস্য ফাঁস হয়ে পড়বে। দুদকের যেসব কর্মকর্তা জাহালমকে ফাঁসাতে সহায়তা করেছেন তাঁদেরও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তাহলে সর্ষের মধ্যে যেসব ভুত বিদ্যমান তাঁরাও ধরা পড়বেন।

জাহালম সেজে যে আবু সালেক ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন তিনি কি কোনও জাদুকর? কারুর কাছেই তাঁর জাল-জোচ্চুরি ধরা পড়লো না? এতো জাদু লোকটি শেখলেন কোত্থেকে? এমনটি কি সত্যি সত্যি সম্ভব? ঠাকুরগাঁওয়ের আবু সালেকেরতো এতো দুর্বুদ্ধি হবার কথা নয়। তাছাড়া লোকটি খুব লেখাপড়া জানেন বলেও মনে হয় না। এসএসসি পর্যন্ত পড়া বাড়ি থেকে বাবার তাড়িয়ে দেয়া আবু সালেক সিলেটের জাহালম সেজে কীভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে ভেগে গেলেন তা ভাবা যায়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভ চুরি হয়ে যায় আমেরিকার ব্যাংক থেকে। এ নিয়ে সম্প্রতি মামলা নাকি একটা হয়েছে। কিন্তু কার বিরুদ্ধে? ফিলিপাইনের এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। এর জন্য তাঁর শাস্তির কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিবি’র যারা জড়িত তাঁদেরতো পশমও স্পর্শ করছে না কেউ! কেন, সমস্যা কি তাহলে অন্যরকম?

খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, চাকরি করেন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির। চলেন রাজকীয় হালে। একাধিক আধুনিক মডেলের গাড়ি, আলিশান বাড়ি, অভিজাত এলাকায় জমির প্লট, ফ্ল্যাট, কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স এবং ইউরোপ-আমেরিকায় বাড়ি। আফজালদের মতো বিদেশি ব্যাংকেও অঢেল টাকার একাউন্ট আর সম্পদ। সবার অবশ্য এমন নেই। তবে অনেকেরই আছে।

জনগণের টাকা মেরে, ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে অথবা ঘুষ হিসেবে নানাভাবে লুট করে যারা টাকার পাহাড় জমান তাঁরা চিরদিন বেঁচে থাকবেন না। আর যারা দিন আনেন দিন খান তাঁরাও কবরে যাবেন। মরতে হবে সবাইকে। তাহলে পরের ধন মেরে পাহাড় গড়ে কী লাভ, জানেন কেউ? জমানো অর্থের পাহাড়, বাড়ি, গাড়ি সবইতো বারো ভুতে খাবে। কবরে কিছুই যাবে না। তবুও লোভী মানুষ অন্যের মেরেকেটে সম্পদের পাহাড় গড়েন। গরিব ও নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিয়ে দিতে আবু সালেকদের মোটেও বাধে না।

ঠাকুরগাঁওয়ের আবু সালেক ২১ কোটি টাকা পাটকল শ্রমিক জাহালমের নামে ব্যাংক থেকে নিয়ে ভেগে গেলেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেলেন না। দুদকের সাহেবরাও তদন্তে ধরতে পারলেন না। সবই কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? সবাই ভুল করেছেন? দুদকের এক কমিশনার বলেছেন, ‘জাহালমের ব্যাপারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ ইত্তেফাক: ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।

উল্লেখ্য, সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির ২৬ মামলায় বিনাদোষে জাহালমকে ৩ বছর কারাভোগ করতে হয়েছে। এতো মামলার সবগুলোই ভুল? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হলে এতো ভুল কি এমনই এমনই হয়েছে বলে দুদক কমিশনার মনে করেন?

যাই হোক, মহামান্য উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে দীর্ঘ জেলজুলুমের শিকার জাহালম সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই স্বস্তির খবর। কিন্তু জাহালমের জীবন থেকে অতীত হয়ে যাওয়া তিন বছর ফিরিয়ে দিতে পারবেন কেউ? এর ক্ষতিপূরণ কি টাকা দিয়ে সম্ভব? নিশ্চয়ই না। তবে সদ্য কারামুক্ত জাহালমকে দুধে গোসল করাবার বিষয়টিও বেশ আবেগতাড়িত। অশোভন এবং বাড়াবাড়ি।

http://www.dailysangram.com/post/364392