৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ১২:০০

চীনা বিনিয়োগ ও ঢাকার আসিয়ান সংযোগ

মাসুম খলিলী

বাংলাদেশে চীনের ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ বিতর্ক যে শুধু বাংলাদেশে সীমিত তাই নয়; প্রতিবেশী মিয়ানমার-ভারত এমনকি পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কায়ও রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিতর্কের কেন্দ্রে থাকে ভূ-কৌশলগত মেরুকরণ বা হিসাব-নিকাশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক সহায়তা এমন একটি বিষয়, যা একটি দেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তি হতে পারে, আবার তা হতে পারে লুণ্ঠনের হাতিয়ারও।

চীন বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে। এর অর্ধেক অর্থ ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পের অনুকূলে অবমুক্ত করা হয়েছে। বাকি অর্ধেক অর্থ আছে পাইপলাইনে। এর বাইরে আরো ১২ বিলিয়ন ডলার সুবিধাজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে চীন। এই বিনিয়োগের বড় অংশ অবকাঠামো প্রকল্পে খরচ করা হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন এমন একটি ক্ষেত্র, যেটি সঠিকভাবে বাছাই করা গেলে তা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিকাশের অনুকূল হয়। আর সঠিকভাবে বাছাই করতে ব্যর্থ হলে এটি রাষ্ট্রের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা হিসেবেই চেপে বসে।

চীন ও ভারত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দুই প্রধান শক্তি। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার বিষয় বাদ দিলেও অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতার বিবেচনায় ভারতের তুলনায় চীন অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যথেষ্ট হবে যে, চীনে ভারতের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্র নেই। এর বিপরীতে, ভারতে অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ হলো চীন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দুটো দেশের বিনিয়োগসক্ষমতার বিষয়টি গভীরভাবে অবলোকন করতে পেরেছেন। সম্প্রতি তিনি সিএনএন-নিউজ এইটিন নামের ভারতীয় টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে তিনি অনেক কথা বলেছেন। এর মধ্যে চীন-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যও রয়েছে। শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড (ওবিওআর) প্রকল্পে ভারতকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভারতের মতো এত বড় দেশ, এত বড় যার অর্থনীতি, তার উচিত না (চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড প্রকল্প নিয়ে) চিন্তিত হওয়া; বরং অর্থনৈতিক স্বার্থে ভারত এর সাথে যুক্ত হতে পারে। বিশ্ব এখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কানেক্টিভিটির দরকার। এটা খুবই জরুরি। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ইতোমধ্যে কানেক্টিভিটির বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে; বিসিআইএম (ভারত-চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যাওয়ার পর মনে করা না যায়, ভারতের দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকতে পারে। বরং আমার মনে হয়, এতে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। এতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার সবাই লাভবান হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কানেক্টিভিটি জরুরি। যদি কোনো বিষয় নিয়ে শঙ্কা থাকে, তাহলে ভারত দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধানে উদ্যোগী হতে পারে। ভারত ও চীন উভয়েই আমাদের প্রতিবেশী।’

শেখ হাসিনা সম্ভবত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের যে অংশটি বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-চীন-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-লাওস-কম্পোডিয়া-ভিয়েতনাম ঘিরে, তার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত একটি মহাপরিকল্পনা হলো, এসকাপের এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে। এ দু’টি প্রকল্পের আওতায় এশিয়ার দক্ষিণ ও পূর্ব অংশের মধ্যে একটি অভূতপূর্ব সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ার কথা। অবশ্য এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দ্রুত গতি আর থাকেনি। তবে এর সাথে সংযোগ রেখে বিভিন্ন দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। বাংলাদেশে গত দেড় দশকে এশিয়ান হাইওয়ের আওতায় আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির সাথে যুক্ত মহাসড়কগুলোর উন্নয়নকাজ অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাত রাজ্যের কানেক্টিভিটির স্বার্থ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের মূল দর্শন হলো, এক দেশের রাজধানীর সাথে অন্য দেশের রাজধানীর প্রত্যক্ষ সংযোগ সৃষ্টি করা। তবে এই সংযোগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সম্মত না হলে এসকাপের ফোরামে সেটি অনুমোদন লাভ করতে পারে না। এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, উভয় ক্ষেত্রে ঢাকা-দিল্লির পাশাপাশি ঢাকা-ইয়াঙ্গুন (বর্তমানে নেইপিডো) প্রত্যক্ষ সড়ক ও রেল সংযোগের প্রস্তাব ছিল।

ভূ-কৌশলগত ও বাণিজ্যিক বিবেচনায় এটি করা হলে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সাথে সরাসরি সংযুক্ত হবে ঢাকা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যতখানি স্বার্থ যুক্ত রয়েছে, ততখানি ছিল না মিয়ানমারের। কারণ, মিয়ানমারের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ চীন ও আসিয়ানের সাথে স্থল সংযোগে যে বাজার সুবিধা পাওয়ার কথা, সে ধরনের কোনো স্বার্থ মিয়ানমারের নেই। এ ছাড়া, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক যতখানি আগে থেকে বিদ্যমান ও সহজে স্থাপনযোগ্য, ততটা নেই মিয়ানমারে। ফলে এসকাপের ফোরামে মিয়ানমারের সম্মতির অভাবে ঢাকা-কক্সবাজার-মান্দালয় রুটটি মুখ্য সংযোগ হিসেবে অনুমোদিত না হয়ে বিকল্প মহাসড়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

উল্লিখিত কানেক্টিভিটির ব্যাপারে এর মধ্যে মিয়ানমারের স্বার্থের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে, এটি বলা যাবে না। তবে চীনা স্বার্থ এই কানেক্টিভিটির সাথে অত্যন্ত গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আর চীন মিয়ানমারের এতটাই প্রভাবশালী অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক অংশীদার যে, বেইজিংয়ের স্বার্থ উপেক্ষা করা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কিংবা দেশটির স্টেট কাউন্সিলর সু চির রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে বেশ কঠিন।

গত সপ্তাহের শেষ দিকে চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে কিউকপিউ থেকে মান্দালয় হয়ে ইউনান পর্যন্ত একটি মহারেলপথ নির্মাণের ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। মান্দালয় থেকে একটি রেললাইন নেপিদো হয়ে ইয়াঙ্গুন যাবে। চীন রেলওয়ের ইরিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) এবং বৃহত্তর বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অংশ মুনসেন-মান্দালয়-কিউকপিউ রেলওয়ের জন্য আংশিক জরিপ শুরু করেছে। মিয়ানমার প্রকল্পটির জন্য যে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে তা গত অক্টোবরে হাতে নেয়া দেশের বৃহত্তম সড়ক ও রেল প্রকল্পের একটি হতে পারে।
প্রকল্পটিতে চীনের কুনমিং থেকে মিয়ানমার-চীন সীমান্তে এবং সেখান থেকে মান্দালয় পর্যন্ত এবং এরপর রাখাইনের কিউকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরের সাথে যুক্ত করার জন্য, হাইস্পিড রেলওয়ে লাইন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। মিউস থেকে মান্দালয় পর্যন্ত ৪৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনটি দিয়ে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এই রেলপথে সাতটি মালবাহী স্টেশন এবং পাঁচটি যাত্রী স্টেশন থাকবে। চীনকে মিয়ানমারের কিউকপিউ স্পেশাল ইকোনমিক জোন এবং গভীর পানির বন্দরের সাথে সংযুক্ত করার প্রকল্পটিকে দেখা হচ্ছে বৃহত্তর চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে।

বস্তুত চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বরাবর এই রেলপথের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে গেছে দু’টি বিশাল গ্যাস ও তেল পাইপলাইন। মালয়েশিয়ার ভঙ্গুর মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প, জ্বালানি পরিবহনের পথ হলো এটি, যা চীনের জন্য অতি অগ্রাধিকারের একটি প্রকল্প। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের যে প্রকল্পের উদাহরণ শেখ হাসিনা দিয়েছেন, সেই কানেক্টিভিটি ও অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের মিয়ানমারের অংশ এটি। এর পাশাপাশি, মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সংযোগ অংশটিও পরিকল্পনামতো বেশ এগিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কিউকপিউ-মান্দালয়-নেইপিডো-ইউনান রেলপথ ও মহাসড়ক নির্মিত হওয়ার একই সময়ে নেইপিডো-ব্যাংকক সংযোগ রেলপথ ও মহাসড়কের ‘মিসিং লিঙ্ক’গুলোও তৈরি হয়ে যাবে।

মিয়ানমারের পরিকল্পিত কিউকপিউ বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য দিয়ে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগ ঘটাবে। এটি ছাড়াও কয়েকটি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ কমপক্ষে হাফ ডজন বন্দরের পরিকল্পনার মাধ্যমে মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রে নিয়ে আসছে বেইজিং। মিয়ানমার ও চীনা সরকারের মধ্যে সম্প্রতি যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো কৌশলগত ভিশনকে জোরালো করেছে, বহু দশক ধরে যেগুলো কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছিল।

মিয়ানমারের পরিস্থিতির গভীর পর্যবেক্ষক ল্যারি জ্যাগানের মতে, ‘মিয়ানমারের দিক থেকে এগুলো অভ্যন্তরীণ সংযোগ স্থাপন এবং জাতীয় পরিবহন কাঠামো উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চীনের জন্য এটা কৌশলগত ভিশনের মূল বিষয়। এই বন্দরগুলো রেলওয়ে ও সড়কের মাধ্যমে উত্তরে চীন এবং পূর্বে থাইল্যান্ডের সাথে যুক্ত হবে। চীন যেহেতু পশ্চিম উপকূলে রেল ও সড়কগুলোকে যুক্ত করতে চায়, তাই এটাকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বইয়ের লেখক আন্দ্রে হুইলারের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন ল্যারি। এতে হুইলার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মিয়ানমার (বিআইসিএম) অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে ভারতের সাথে মতভেদ তৈরি হওয়ার কারণে কৌশলগত বিকল্প হিসেবে চীন-মিয়ানমার সংযোগের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।’ তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু এটা বেইজিংকেই সবচেয়ে বেশি উপকৃত করবে এবং মিয়ানমারের জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্ব রয়েছে।’

এটি ঠিক যে, বিআরআই শুধু কিছু অবকাঠামো নয়। অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে সরবরাহ ও পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, যেটার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে এ অঞ্চলের। এটা পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষের কাছে একটা প্রস্তাবের মতো, যার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম বড় বাজারের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, যেটার সাথে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ মানুষ জড়িত এবং উৎপাদনের দিক থেকে পৃথিবীতে যেটি তৃতীয়।

হুইলার বলেছেন, ‘এই পর্যায়ের সংযোগ অর্জনের জন্য মেরিটাইম সিল্ক রোডের সাথে অভ্যন্তরীণ বেল্ট ও কৌশলগত বন্দরগুলো যুক্ত হবে। বন্দরের সাথে রেল নেটওয়ার্কের সংযোগের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, বর্তমানের বন্দর থেকে বন্দর মডেল নয়, যাতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের শেষ পর্যন্ত পরিবহন নিশ্চিত করা যায়।’ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটা চীনের সাথে ইউরোপের বাণিজ্য পরিবহনকে আরো সহজ ও উন্নত করবে।

প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ এই নেটওয়ার্ক থেকে কিভাবে সুবিধা পাবে? এই সুবিধার জন্য ঢাকা বিসিআইএম প্রকল্পের বাস্তবায়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হতে হবে। বিকল্প হিসেবে মিয়ানমার ও চীনের সাথে ত্রিপক্ষীয়ভাবে এই নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। বিসিআইএম করিডোর স্বাক্ষরকারী চার দেশই একমত হয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। ভারতের সাথে কানেক্টিভিটিতে যুক্ত কম্পোনেন্টগুলোর বড় অংশ এর মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। অবশ্য ভারতের একটি অভিপ্রায় হলো, এই নেইওয়ার্কটি বিবিআইএন (বাংলাদেশ ভারত ভুটান নেপাল) উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামের মধ্য দিয়ে হবে, যার সাথে চীন যুক্ত নয়। আর সেটি করা হলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরাসরি সংযোগ এই প্রকল্পের মাধ্যমে হবে না। ঢাকার দিল্লিনির্ভরতা বৃদ্ধির চেয়েও চীননির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। শেখ হাসিনার বক্তব্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, চলমান অবকাঠামো নেটওয়ার্কের সাথে চীন যুক্ত হলেই তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

হাজার কোটি টাকার বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে ক্ষুদ্র বা মাঝারি অর্থনীতির কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে বিনিয়োগ করার অবকাশ থাকে না। বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভবই নয়, এমনকি ভারতও অনেক বড় প্রকল্পে নিজস্ব সূত্র থেকে বিনিয়োগের সামর্থ্য রাখে না। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সম্পূরক হিসেবে যে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছেÑ সেই ব্যাংক দু’টি আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি প্রকল্পে অর্থায়নে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ জোগানদাতা হলো চীন। চীনকে বাদ রাখা হলে এই কানেক্টিভিটি প্রকল্প সফল হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

বাংলাদেশ এশিয়া হাইওয়ে ও ট্র্যান্স এশিয়ান রেলওয়ের দু’টি প্রকল্পেরই অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম ম মুস্তফা কামাল আঞ্চলিক রেলপথের সাথে মিল রেখে দেশের সব রেলপথকে ব্রডগেজ করার পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছেন। নতুন অর্থমন্ত্রী একজন ডায়নামিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তার সাথে ব্যবসায়িকভাবে চীনের সাথে সুসম্পর্কের বিষয়টি বেশ পুরনো।

এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল দুইজনই বিসিআইএম নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণের কারণে এই করিডোরের বাংলাদেশের অংশটির কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে চীনের বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা ইতিবাচক হতে পারে। ভারত এ মুহূর্তে কতটা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আগামী মে মাসের লোকসভা নির্বাচনের পর এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হবে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি। মোদি, রাহুল বা মমতা যিনিই ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে বিসিআইএম নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন দ্রুততর হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের শর্তাবলি কঠোরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় যেন প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং অযৌক্তিক ঋণের বোঝা দেশের ওপর যাতে চেপে না বসে, সে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি কৌশলগত নানা সুযোগ সৃষ্টি হবে ঢাকার জন্য। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের ক্ষেত্রেও এটি অনুকূল একটি বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। হ

mrkmmb@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/386656