৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৫

শিক্ষক বেসরকারি কলেজ সরকারি!

২৯৯ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক কর্মচারী উদ্বিগ্ন

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজ সরকারি হয় গত বছরের ১২ আগস্ট। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার এক মাসের মধ্যে কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেনের বয়স ৫৯ বছর পূর্ণ হয়। সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে, ৫৯ বছর বয়সে তার অবসরে যাওয়ার কথা। তবে তার চাকরি সরকারি না হওয়ায় এখনও তিনি অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কারণ বেসরকারি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতায় অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর।

এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেলে তিনি অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের সামান্য কিছু টাকা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই পাবেন না। অথচ সরকারি শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেলে তিনি পেনশন পেতেন। শুধু তিনি নন, তার কলেজের ৯০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কেউই এখনও সরকারি হতে পারেননি।

একাডেমিক সংকটের কথা তুলে ধরে দেলোয়ার হোসেন বলেন, কলেজ সরকারি হওয়ায় এখানে বেসরকারিভাবে আর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ কলেজ সরকারি হওয়ার আদেশের পর অনেকেই অবসরে চলে যাওয়ায় সেসব পদ শূন্য হয়ে গেছে। শিক্ষক সংকটে রুটিনমাফিক ক্লাস চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অধ্যক্ষ জানান, তিনি হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তাকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ম্যানেজমেন্ট, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ও বিজনেস কমিউনিকেশনের ক্লাস নিতে হচ্ছে।

কলাপাড়ার এ কলেজের মতোই বৈপরীত্যময় অবস্থায় চলছে সারাদেশের ২৯৯টি কলেজ। এসব কলেজ সরকারি, তবে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেসরকারি। কারণ তাদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদা বেসরকারি পর্যায়ের। অন্যদিকে, সরকারি কলেজের বেতন মাত্র ২৫ টাকা হলেও এসব কলেজের দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে মাসে মাসে বেসরকারি কলেজের বেতন, টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দেওয়া বেতন, ফি ও সরকারি এমপিওভুক্তির অর্থ থেকে বেসরকারি এই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

গত বছরের ১২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে একযোগে সারাদেশের ২৯৯টি বেসরকারি কলেজ সরকারি করা হয়। তবে ১২ আগস্ট প্রজ্ঞাপন হলেও তা কার্যকর করা হয় আরও চার দিন আগে, ৮ আগস্ট থেকে। সে হিসাবে এ কলেজগুলো পাঁচ মাস সাত দিন আগে সরকারি হলেও শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি বেসরকারিই রয়ে গেছে। পদ সৃষ্টি না হওয়ায় তাদের সরকারি চাকরিতে আত্তীকরণ করা যায়নি। ২৯৯টি কলেজে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। তাদের অনেকেই গত পাঁচ মাসে অবসরে চলে গেছেন। আবার অনেকের অবসরের সময় আসন্ন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুসারে, এসব কলেজে ডিগ্রি থাকলে প্রতিটি বিষয়ে তিনজন, অনার্স থাকলে কমপক্ষে সাতজন এবং মাস্টার্স থাকলে কমপক্ষে ১২ জন শিক্ষক থাকার কথা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কর্মচারীও থাকবে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অবসরজনিত কারণে পদ শূন্য হওয়ায় অনেক বিভাগে (বিষয়ে) একজন মাত্র শিক্ষক অনার্স স্তরে পড়াচ্ছেন। এতে কলেজগুলোর একাডেমিক কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে এসেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায় অনুসারে, সরকারি কলেজেবিহীন প্রতি উপজেলায় একটি করে বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণের আওতায় সরকারের গত মেয়াদে মোট ৩২৪টি কলেজ সরকারি করা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১২ আগস্ট একই দিনে এক আদেশে ২৯৯টি কলেজ সরকারি হয়। এই কলেজগুলোতে সরকারিভাবে শিক্ষক-কর্মচারীর পদ সৃষ্টি না হওয়ায় কর্মরতরা কেউ আত্তীকরণ হতে পারেননি। এসব কলেজের শিক্ষকের মর্যাদা এবং বদলি ও পদোন্নতি কীভাবে হবে, তা নির্ধারণ করতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। পরে 'আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮' নামে নতুন বিধি প্রণয়ন করে এই ২৯৯টি কলেজ সরকারি করা হয়। ৩২৪টি কলেজের বাকি কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা 'আত্তীকরণ বিধিমালা-২০০০' অনুসারে সরকারি হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে পদ সৃষ্টির জটিলতা তৈরি হয়নি।

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, এসব কলেজের শিক্ষকরা সরকারি হওয়ার পর পিএসসির অধীনে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডারভুক্ত হতে পারবেন। আবার নন-ক্যাডার হিসেবেও থাকতে পারবেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চাকরি সরকারি না হওয়ায় এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তি ও আগের বেতন-ভাতাই চালু রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে যাদের বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা আছে, তারা সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে পরীক্ষা দিয়ে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। যারা ক্যাডারভুক্ত হবেন, তারা বদলি হতে পারবেন। আর যারা পরীক্ষা দেবেন না, তারা নন-ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে নিজ নিজ কলেজেই চাকরি করতে থাকবেন। বদলিও হতে পারবেন না।

পদ সৃষ্টির চারটি মডেল প্রস্তাব :মন্ত্রণালয়ের এক নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, সরকারি পদ সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। শিক্ষা, অর্থ, জনপ্রশাসন ও সচিব কমিটির অনুমোদন লাগে এ কাজে। এরই মধ্যে এসব কলেজে পদ সৃজনের জন্য চারটি কলেজের চারটি পৃথক মডেল ধরে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, এ কলেজগুলোর জনবলের চারটি পৃথক প্যাটার্ন তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা যেটি অনুমোদন করবে, সেটিই অনুসরণ করা হবে। একাডেমিক সমস্যার বিষয়টি সরকারের নজরে আছে বলেও জানান মহাপরিচালক।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, 'একটি একটি করে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণ করতে গেলে আগামী এক বছরেও ২৯৯টিতে তা করা সম্ভব হবে না। তাই ঢাকার চারটি কলেজের পদ অনুসারে মডেল অর্গানোগ্রাম তৈরি করে সরকারি হওয়া কলেজের পদ সৃজনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামতের পর পদ সৃষ্টি হবে।' তিনি জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চারটি পৃথক মডেল প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের সরকারি ইস্পাহানী কলেজ, সাভার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সরকারি দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ এবং সরকারি পদ্মা কলেজের পদ অনুসারে। যে মডেলটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাবে, সেটি অনুসরণ করে বাকি সব কলেজে পদ সৃষ্টি করা হবে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, পদ সৃষ্টির কাজটি বেশ জটিল। প্রতিটি কলেজের প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মচারীর তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। কারণ, সরকারীকরণের সময় কতিপয় দুস্কৃতকারী লোক নানা কায়দায় সরকারি চাকরিতে অন্যায়ভাবে প্রবেশের সুযোগ খোঁজে।

অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, জনপ্রশাসন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সব শিক্ষক-কর্মচারীকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তবে ক্যাডারভুক্তির জন্য বিধিমালায় যে পরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে, সেখানে সবাই পরীক্ষা দিতে পারবেন না। যেমন, কারও বয়স যদি ৫৯ বছর হয়, তিনি তো আর পরীক্ষা দিতে যাবেন না। এ রকম কিছু বিষয় সম্পর্কে পৃথক আরেকটি বিধি করবে পিএসসি। এতে নির্ধারণ করা হবে কারা কোন যোগ্যতা থাকলে ক্যাডারভুক্তির জন্য পরীক্ষা দিতে পারবেন।

আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পদ সৃষ্টির ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সভা রয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সরকারি কলেজ শিক্ষক পরিষদের (সাবেক নাম জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষক পরিষদ-জাকশিপ) আহ্বায়ক মো. ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করে তাদের আত্তীকরণে দেরি করা হচ্ছে। বছর পেরিয়ে গেলে অনেক শিক্ষকের চাকরিকালও কমে যাবে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আত্তীকরণ বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান।

শিক্ষকদের কথা :যশোরের সরকারি কেশবপুর কলেজের সমাজকর্ম বিষয়ের শিক্ষক মোহসীন হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদারতায় তারা সরকারি কলেজের মর্যাদা পেয়েছেন। আত্তীকরণ কেন ঠেকে থাকবে তা হলে? শরীয়তপুরের গোসাইরহাট সরকারি শামসুর রহমান সরকারি কলেজের প্রভাষক কামরুল ইসলাম বলেন, কলেজ সরকারি হলে আমরা কেন অর্ধেক বছর ধরে বেসরকারি থাকব? নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার সরকারি কদমরসুল কলেজের প্রভাষক শাহাব উদ্দিন বলেন, কলেজ সরকারি হলেও আমরা এখনও বেসরকারি আছি, লজ্জায় এটা কাউকে বলা যায় না। সরকারি হওয়ার আগেই অনেকে অবসরে চলে যাচ্ছেন। তাদের কষ্ট আরও বেশি। নীলফামারীর জলঢাকা সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সব শিক্ষক-কর্মচারীকে কালবিলম্ব না করে আত্তীকরণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

এসব কলেজের কয়েকজন অভিভাবক সমকালকে বলেন, কলেজ সরকারি হয়েছে- তা হলে কেন এর সুফল পাচ্ছি না? কেন বেশি বেতন দিতে হচ্ছে? শিক্ষকশূন্যতায় ক্লাস ঠিকমতো হয় না কেন?

মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য :শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সমকালকে বলেন, ২৯৯টি কলেজে পদ সৃষ্টির বিষয়টি এককভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন, অর্থ ও সচিব কমিটির নানা অনুমোদনের বিষয় সম্পৃক্ত। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে। সেটিকে কমিয়ে আনতে তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, তারা গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে এসব কলেজের পদ সৃষ্টির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে একটি 'ইউনিক ফরম্যাট' তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের অনুমোদন মিললে অর্থ ও সচিব কমিটির কাছে দ্রুত উত্থাপন করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব কাজটি শেষ করতে তারা আন্তরিক চেষ্টা করছেন।

https://samakal.com/bangladesh/article/1902424/