৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১১:৫২

এনটিআরসিএর প্যাঁচে বেসরকারি শিক্ষকরা

নিয়োগ পেয়েও বহু বাধা যোগদানে

অষ্টম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মাহমুদা আক্তার লিজার স্কোর ৪৯.৫। এবার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে তিনি ৭২টি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু একটিতেও নিয়োগের সুপারিশ পাননি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ)। অথচ প্রতিটি আবেদন বাবদ ১৮০ টাকা করে তাঁর খরচ হয়েছে মোট ১২ হাজার ৯৬০ টাকা। আরো অনেক প্রার্থী এবার প্রত্যেকে গড়ে শতাধিক আবেদন করেও নিয়োগ পাননি। আবার যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই চাকরিতে যোগ দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নানা জটিলতার মুখে পড়ছেন। যোগ দিতে গিয়ে কেউ জানতে পারছেন সংশ্লিষ্ট পদটির কোনো অনুমোদনই নেই, আবার কেউ জানছেন, পদটি এমপিওভুক্ত নয়, এমনকি পরবর্তী সময়ে এমপিওভুক্ত হবে কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মাহমুদা আক্তার লিজা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যারা চাকরিপ্রার্থী তাদের জন্য অল্প টাকাও অনেক বড় ব্যাপার। ইচ্ছা করলে তো একটি আবেদনেই একাধিক পছন্দ দেওয়ার সুযোগ রাখা যায়। বিভিন্ন ভর্তিপ্রক্রিয়ায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তাহলে আমাদের এত টাকা খরচ হতো না। এতে চাকরি না হলেও দুঃখ থাকত না এতটা।’

সদ্য নিয়োগ পাওয়া আসমা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বরিশালের রাঙ্গাবালী সালেহা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছি। কিন্তু এই স্কুলে যোগাযোগের পর বলা হয়, তাদের এমপিওভুক্ত পদ শূন্য নেই। এখন যদি পদই না থাকে, তাহলে আমাকে কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন প্রার্থী বলেন, ‘আমাকে যশোরের একটি কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু ওই কলেজে যোগাযোগের পর বলা হয়েছে, আগে ৪০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে। এতে উত্তীর্ণ হলে তার পরই নিয়োগ দেওয়া হবে। এখন যদি পরীক্ষাই দিতে হয়, তাহলে কেন এনটিআরসিএ নিয়োগের সুপারিশ করল?’

জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় ৩৯ হাজার ৫৩৫টি পদে নিয়োগের সুপারিশ করে এনটিআরসিএ। তবে এ নিয়োগের জন্য গত ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পান চাকরিপ্রার্থীরা। নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় এক লাখ ২০ হাজার চাকরিপ্রার্থী ২৫ লাখ ৭৯ হাজার ১৯৬টি আবেদন করেন। এতে এক দফায় এনটিআরসিএর আয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৪২ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০ টাকা। কিন্তু এত টাকা আয় করেও নিয়োগ-পরবর্তী জটিলতা নিরসনের কোনো দায় নিচ্ছে না এনটিআরসিএ।

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নন-এমপিও স্কুলেও নিয়োগের জন্য এনটিআরসিএ অনেক প্রার্থীর নাম সুপারিশ করায় নানা জটিলতায় পড়ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বেতন পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

জানা যায়, তালিকাভুক্ত প্রায় ৩১ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমপিওভুক্ত ২৮ হাজার। ফলে নন-এমপিও তিন হাজার প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করছে এনটিআরসিএ। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখা এমপিওভুক্ত; কিন্তু কলেজ শাখা নয়। অথচ প্রার্থীরা যখন আবেদন করেছেন, তখন পুরো প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত দেখানো হয়েছে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের নিম্ন মাধ্যমিক শাখা এমপিওভুক্ত হলেও মাধ্যমিকে এমপিও নেই। সেখানেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকেও নন-এমপিও পদের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় প্রার্থীরা পদটিকেও এমপিওভুক্ত হিসেবে ধরে নেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রার্থী বলেন, ‘একটি কলেজে আমাকেসহ পাঁচজনকে নিয়োগের সুপারিশ দিয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পাঁচজনই গিয়ে দেখি, মাত্র একটি পদে এমপিও আছে। ফলে আমরা পাঁচজনই এখন জটিলতায় পড়েছি।’

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার একটি কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া এক প্রার্থী কলেজে গিয়ে জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত নয়। ওই প্রভাষককে মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে বলে জানায় কলেজ কর্তৃপক্ষ। অথচ এমপিওভুক্ত কলেজে একজন প্রভাষকের প্রারম্ভিক বেতন ২২ হাজার টাকা।

এসব জটিলতার কথা চিন্তা করে গত মঙ্গলবার একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে এনটিআরসিএ। এতে বলা হয়েছে, এনটিআরসিএ যেসব নন-এমপিও পদে সুপারিশ করেছে, সেসব পদ পরবর্তী সময়ে এমপিওভুক্ত হবে কি না, তা জেনে নিয়েই যোগদান করতে হবে। যোগদানের পর এনটিআরসিএ সেসব পদের বা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির দায়িত্ব নেবে না। পদটি অননুমোদিত বা নন-এমপিও হলেও সব স্তরে শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এ কারণে এনটিআরসিএ নন-এমপিও পদেও নিয়োগের সুপারিশ করছে। তবে যেসব প্রার্থী নন-এমপিও পদে যোগদান করবেন, তাঁরা ভবিষ্যতে এমপিওভুক্ত হবেন না, সেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই তাঁদের যোগ দিতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত জনবল কাঠামোর বাইরে নন-এমপিও বা অননুমোদিত পদ এমপিওভুক্ত করা হবে না।

এনটিআরসিএ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে আরো ৬০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এনটিআরসিএর তালিকাভুক্ত ৩১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বশেষ ১৫ হাজার প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৯ হাজার শূন্যপদের বিপরীতে চাহিদা পাওয়া গিয়েছিল। বাকি ১৬ হাজার প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৬০ হাজার পদ শূন্য থাকার আশঙ্কা আছে। সূত্র মতে, আগামী দুই মাসের মধ্যে শুধু নারী কোটায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই সব প্রতিষ্ঠানের চাহিদা নিয়ে প্রকাশ করা হবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।

এনটিআরসিএর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হোক আর না হোক, সব প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগের সুপারিশ করবে এনটিআরসিএ। সেই হিসেবে আমরা নিয়োগ দিই। আর প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যদি নন-এমপিও পদকে এমপিও হিসেবে দেখায়, আমাদের যাচাই করার সুযোগ নেই।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও ভুল করেছে, এটা ঠিক। আবার এনটিআরসিএর সফটওয়্যারে যেভাবে নন-এমপিওর অপশন আছে, সেটাও ভালো কথা নয়। এখন কাঠামোর বাইরে যেসব পদে সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের কোনোভাবেই এমপিও দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এনটিআরসিএর কাছে পদের চাহিদা আসার পর সেসব তথ্য সঠিক আছে কি না, আমাদের কাছে তা জানতে চাইলে খুব সহজেই বের করে দিতে পারি। আমার মনে হয়, শিক্ষক নিয়োগে মন্ত্রণালয়, মাউশি ও এনটিআরসিএর সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার। তাহলে অনেক সমস্যাই কমে যাবে।’

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এস এম আশফাক হুসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব ধরনের নিয়ম মেনেই যথাযথভাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী নিয়োগপ্রক্রিয়াও আমরা দ্রুততার সঙ্গে শুরু করার চেষ্টা করছি।’

এনটিআরসিএর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আসলে আবেদন করার সময়ই প্রতিষ্ঠান এমপিও না নন-এমপিও, তা জেনে প্রার্থীদের আবেদন করা উচিত ছিল। আর কোনো প্রতিষ্ঠান যদি শূন্যপদের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেয়, তাহলেও এনটিআরসিএর কিছু করার নেই। তবে যাঁরা নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন, তাঁরা যোগদান করতে চাইলে সবাই নিয়োগ পাবেন। নিয়োগ না দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান পার পাবে না।’ ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘এনটিআরসিএ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমাদের যাবতীয় খরচ নিজেদের আয় থেকেই নির্বাহ করতে হয়। আর একটি আবেদনের মাধ্যমে একাধিক পছন্দের সুযোগ রাখতে হলে সফটওয়্যার পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য কমপক্ষে এক বছর সময় প্রয়োজন। আর এই এক বছর যদি নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়, তাহলে প্রার্থীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরি হবে। তাই এনটিআরসিএ কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/02/07/734501