৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৩

বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

অবলোপনকৃত ঋণ আদায় হতাশাব্যঞ্জক

সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মোট স্থিতি ছিল আট হাজার ৬১৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে কিছুটা সফলতার মুখ দেখছে ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজমেন্ট। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বার্ষিক (জুলাই ১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে এই ব্যাংকের জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ৭০ কোটি টাকার স্থলে আদায় হয়েছে ৭৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ এখন পর্যন্ত বেশি রয়েছে। চুক্তিতে পুরো অর্থবছরে খেলাপি ঋণ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা থেকে সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার টার্গেট দেয়া হয়েছে।

খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ বাড়লেও অবলোপনকৃত ঋণ (খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর জন্য যে ঋণকে মূল হিসাবে তালিকা থেকে সরিয়ে রাখা হয়) আদায়ের ক্ষেত্রে বেসিক ব্যাংক অনেক পিছিয়ে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের টার্গেট ছিল ১০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ছয় মাসে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করার কথা ছিল পাঁচ কোটি টাকা; কিন্তু আলোচ্য সময়ে বেসিক ব্যাংক এ খাত থেকে আদায় করতে সমর্থ হয়েছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। একইভাবে আলোচ্য সময়ে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। ছয় মাসে কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। ছয় মাসে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে ৮৩৮ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এই ব্যাংকের প্রদেয় মোট ঋণের প্রায় অর্ধেকটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণের কারণে বেসিক ব্যাংক বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকট মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সঙ্কট কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এর আগে তিন দফায় দুই হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। প্রথমবার ২০১৪ সালে দুই দফায় যথাক্রমে ৭৯০ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৪০০ কোটি টাকা দেয়া হয়। পরে গত বছর দেয়া হয়েছিল আরো এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ সম্পর্কিত অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘অর্থ বিভাগের ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের অনুকূলে মূলধন পুনর্ভরণ খাতে প্রদান করা হলো।’ এরপর ২০১৬-২০১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বেসিক ব্যাংকে আরো কয়েক হাজার কোটি টাকার মূলধন সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল; কিন্তু যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত।

চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করেছে।

৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার বেশির ভাগ ঋণই গুরুতর অনিয়ম সংঘটনের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মতামত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরপর বেসিক ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য একাধিক মামলা করা হয়েছে; কিন্তু কয়েকজন ব্যাংকার ছাড়া এই মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পত্রপত্রিকায় অনেক সমালোচনার পর অবশেষে গত বছর কয়েক দফায় দুদকের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে; কিন্তু তার নামে এখনো কোনো মামলা করা হয়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/386516