৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:২৩

মানুষ এবং নীতির মানুষ

মানুষের আচরণে মানুষ প্রশংসিত হয়, আবার হয় প্রশ্নবিদ্ধও। তবে বর্তমান সভ্যতায় মানুষ প্রশংসিত হওয়ার মতো কাজ কমই করছে। ফলে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এবং বৈশ্বিক পরিম-লে মানুষের দুঃখের মাত্রা বেড়েই চলেছে। তবে আশার কথা হলো, এখনো কিছু মানুষের হৃদয়ে সত্যের প্রদীপ জ্বলছে, সেই আলোয় তারা পথ চলার চেষ্টা করছে। এই পথ চলাটা অবশ্য সহজ নয়, চ্যালেঞ্জের এবং কষ্টেরও বটে। এই চ্যলেঞ্জে অনেক সময় অতি সাধারণ মানুষকেও পথে নেমে আসতে দেখা যায় এবং তারা হয়ে যান খবরের শিরোনামও।

‘কর্নাটকে মদ নিষিদ্ধ করতে চার হাজার নারীর পদযাত্রা’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ৩১ জানুয়ারিতে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, মদ নিষিদ্ধের দাবিতে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে ১২ দিন ধরে চলা ২০০ কিলোমিটার পদযাত্রা শেষে বেঙ্গালুরুতে ৩০ জানুয়ারি সমাবেশ করেছেন নারীরা। এনডিটিভি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, রাজ্যের প্রায় ৪ হাজার নারী ওই পদযাত্রা ও সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। তাদের দাবি, রাজ্যে কোনো ধরনের মদ উৎপাদন এবং বিক্রি করা যাবে না।

উল্লেখ্য যে, পরিবারের মদ্যপ সদস্যদের কারণে ভারতের নারীরা নির্যাতিত। তাই তারা পথে নেমে এসেছেন। যোগ দিয়েছেন পদযাত্রায়। তাদের সবার পরনে ছিল ঐতিহ্যবাহী শাড়ি। ৩০ জানুয়ারি সকালে ওই নারীরা মিলিত হন রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুর মালেশ্বরমে। এই পদযাত্রায় অংশ নেওয়া এক নারীর নাম আম্বিকা। তিনি জানান, স্বামী মদ্যপ অবস্থায় প্রায়ই তাকে মারধর করেন, বলেন, স্বামীর কারণে আমি ভুগছি। মদপান করে সে আমাকে মারধর করে এবং হুমকি দেয়। আমি মরার মতো বেঁচে আছি। তাই মরার আগ পর্যন্ত আমি নারীদের এই প্রতিবাদে থাকবো। আমি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই।

আমার সঙ্গে আমার স্বামী কী করেছে, তা অনেক নারী দেখেছেন। নারীদের ওই পদযাত্রা ও সমাবেশের অন্যতম আয়োজক স্বর্ণাভাট বলেন, ‘মদ বিক্রি, উৎপাদন এবং পান করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। তবে এখন পর্যন্ত কোন রাজনীতিক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন নি। নারীদের এই প্রতিবাদের জন্য এটা অসম্মানের।’

এমন তথ্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, মানুষের সমাজে কেন মদসহ নানা ক্ষতিকর বস্তুর উপদ্রব চলতে পারছে। রাজনীতিবিদদের অনাকাক্সিক্ষত চেহারাটাও আর একবার স্পষ্ট হলো। তাদের অনেকেই যে মদবান্ধব সে বিষয়টিও পরিষ্কার হলো। এখানে আবারও আমাদের স্মরণ করতে হয় যে, মানুষ ও সমাজের কল্যাণের জন্যই মহান ¯্রষ্টা মদকে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। তবে কল্যাণ-অকল্যাণ বুঝতে হলে নীতিজ্ঞান থাকতে হয়।

আমাদের ছোট বেলায় প্রাইমারী স্কুলে নীতিকথা শেখানো হতো। শ্রেণিশিক্ষক একজনকে নীতিবাক্যটি উচ্চারণ করতে বলতেন, পরে ক্লাসের সব ছাত্র সমস্বরে তা বলে যেতো। এতে আমরা বেশ মজা পেতাম। একদিকে শেখা হতো, অন্যদিকে কোরাসকণ্ঠে যেন গান গাওয়া যেতো। গমগম করে উঠতো পুরো ক্লাস। বেশ উদ্দীপনা পেতাম, বুকের মধ্যে সাহসও যেন বেড়ে যেত। লেখাপড়াটাকে তখন বেশ মহৎ বলে মনে হতো। শৈশবে উচ্চারিত সেইসব নীতিবাক্যের একটি ছিল, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ।’

নীতিবাক্যের এই সব পাঠ এখন আর সেভাবে নেই। আধুনিক হতে গিয়ে ঐতিহ্যিক আরও অনেক কিছুর মত এগুলোও আমরা হারাতে বসেছি। আসলে এভাবে কি প্রকৃত আধুনিক হওয়া যায়? মানুষতো তার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞানের আলোকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ঐতিহ্যের ভিতের ওপরই নির্মিত হতে পারে আধুনিকতার প্রকৃত সৌধ। এ প্রসঙ্গে ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

‘মিথ্যা বলায় ব্রিটিশ এমপির দ-’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। খবরটি পড়ে মনে হলো, ছোটবেলায় শেখা নীতিকথার ফল ফলতে শুরু করেছে। ৩১ জানুয়ারিতে মুদ্রিত খবরটিতে বলা হয়, আইনের দেশ বলে কথা। এমপি হলেও রক্ষা নেই। নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালিয়ে জরিমানার টিকিট পেয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের এমপি ফিওনা ওনাসিানিয়া। সেই সামান্য জরিমানা থেকে বাঁচতে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে এখন তাকে জেলে যেতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার লন্ডনের ওল্ড বেইলি আদালত তাকে তিন মাসের কারাদ- দিয়েছেন। ফিনা ওনাসানিয়া ছিলেন বিরোধী দল লেবার পার্টির এমপি। কিন্তু মিথ্যাচারের দায়ে পুলিশ তাকে অভিযুক্ত করার পর পরই দল তাকে বহিষ্কার করে। তবে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে বহাল আছেন তিনি। যুক্তরাজ্যে গত ২৮ বছরের মধ্যে কোনো এমপির কারাদ- হওয়ার এটি দ্বিতীয় ঘটনা।

উল্লেখ্য যে, ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। পিটিারবারা আসনের এমপি ওনাসানিয়ার গাড়িটি ৩০ মাইলের গতিসীমার রাস্তায় ৪১ মাইল বেগে চলছিল। রাস্তায় লাগানো গতি পর্যবেক্ষক ক্যামেরায় বিষয়টি ধরা পড়ে। স্বাভাবিক নিয়মেই গতিসীমা ভঙ্গের দায়ে তার বাসায় জরিমানার টিকিট পাঠানো হয়। কিন্তু ওনাসানিয়া গতি ভঙ্গের বিষয়টি অস্বীকার করেন। এক পর্যায়ে দাবি করেন, ওই সময়ে তিনি গাড়িই চালাচ্ছিলেন না। কিন্তু আদালত প্রমাণ পান যে, এমপি ওনাসানিয়াই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ফলে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ায় এখন তাকে জেলে যেতে হচ্ছে। তাই উপলব্ধি করা যায়, আমাদের ছোটবেলার সেই পুরানো নীতিকথার গুরুত্ব এখনো আছে। অর্থাৎ মিথ্যা বলা এখনো মহাপাপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নীতিকথাকে সব দেশ যথাযথ গুরুত্ব দেয় কী? আমরা তো মনে করি, সবারই যথাযথ গুরুত্ব দেয়া উচিত। নীতিকথাগুলোর পুনঃপাঠও এখনও সময়ের দাবি।

চলমান সভ্যতার সংকট আসলে নীতিভ্রষ্টের সংকট। তাই বর্তমান পৃথিবীতে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অভাব নেই, অভাব নেই আইন অমান্যকারী মানুষেরও। এক সময় তো মধ্যপদের আইন অমান্য করতে দেখা যেত, কারণ মদপানে তারা অসুস্থ হয়ে যেত, বিচার-বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলতো। কিন্তু এখনতো সুস্থ মানুষরা, এমনকি নামিদামী রাজনীতিবিদ ও হর্তাকর্তারাও অবলীলায় আইন অমান্য করে যাচ্ছেন।

কৌশলে মিথ্যাও বলছেন। মেধার চাতুর্য বিবেচনা করে কিছু মানুষ এজন্য অহঙ্কারও প্রকাশ করছেন। এসব মানুষ নিজেদের সুস্থ ও চৌকস মনে করলেও আসলে তাঁরা সুস্থ নন, চৌকসও নন। নৈতিক অধপতনের কারণে তাঁরা প্রকৃত সত্য উপলব্ধিতে অক্ষম হয়েছেন। ইতিহাস এমন মানুষদের জাহেল হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং তাঁদের নেতৃত্বাধীন সমাজকে জাহেলী সমাজ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইতিহাসের এমন সাক্ষ্য থেকেতো অনেক সচেতন মানুষ এখন তাঁদের সমাজ এবং বিশ্বসমাজকে আলো ঝলমলে জাহেলিয়াত হিসেবে বিবেচনা করছেন।

মানুষকে, মানুষের সমাজকে জাহেলিয়াত তথা মূর্খতার অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য মহান ¯্রষ্টা বিভিন্নকালে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূল। তাঁরা মানুষকে এবং মানুষের সমাজকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য সারাজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁরা শিখিয়ে গেছেন, সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হতে হলে সম্মানজনক কাজ করতে হয়। আর এমন অভিযাত্রায় প্রয়োজন হয় ত্যাগ-তিতিক্ষার, উন্নত নৈতিকতার। তাঁরা উদার মন ও প্রশান্ত আত্মার অধিকারী হতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। মানুষকে সংশোধন ও প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য নবী-রাসূলরা নির্মাণ করেছেন উপাসনালয়। কিন্তু সেই উপাসনালয়ে এই আধুনিক যুগেও হামলা হচ্ছে কেন? কারা এই হামলাকারী, এদের পরিচয়ই বা কী?

ফিলিপাইনের গোলযোগপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চলে গত ৩০ জানুয়ারি বুধবার একটি মসজিদে হামলা হয়েছে। এদিন সকালে মিন্দানাও দ্বীপের জামবোয়াঙ্গা শহরের একটি মসজিদে হামলার সময় ব্যবহার করা হয়েছে গ্রেনেড। এতে ২ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য যে, ফিলিপাইনের অধিকাংশ মানুষ ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও মিন্দানাও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল।

এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, কয়দিন আগে সেখানকার একটি ক্যাথলিক গির্জায় হামলা হয়েছিলো। প্রশ্ন জাগে, মসজিদ ও গির্জায় যারা হামলা চালিয়েছে তারা কারা? ধর্মপ্রাণ কোনো মুসলিম বা খ্রিস্টান তো উপাসনালয়ে হামলা চালাতে পারেন না। তাহলে তারা কি আদম শুমারির মুসলিম ও খ্রিস্টান? এমন ধার্মিকের কোনো প্রয়োজন আছে কি ধর্মের?

http://www.dailysangram.com/post/364102