৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ১০:২৪

ইউনিসেফের রিপোর্ট

অনলাইনে ৩২ শতাংশ শিশু ঝুঁকিতে

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ ভাগ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পরিচালিত এক জরিপে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, সমপ্রতি বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাপড়ুয়া ১২৮১ জনের ওপর ওই জরিপ চালানো হয়েছে, যাদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সংস্থাটির তরফে এখনই অনলাইনে শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে সমন্বিত পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘বাংলাদেশে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শিরোনামে পরিচালিত জরিপটি ‘নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস’ উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মন্ত্রীও শিশুদের ঝুঁকির মুখে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এটি মোকাবিলায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন মেয়াদি উদ্যোগের বিস্তারিত তুলে ধরেন। সমীক্ষা বা জরিপ প্রতিবেদন বিষয়ে ইউনিসেফ জানায়- তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত জরিপ এবং ‘এন্ডভায়োলেন্স ইয়ুথ টকস’ শিরোনামে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক আলোচনার ভিত্তিতে ওই রিপোর্ট বা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

জরিপের বিষয়ে প্রায় ৫ সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাপী ১৬০টি দেশের ১০ লাখের বেশি লোক তাদের মতামত দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুদের ওপর এই প্রথম এমন সমীক্ষা হয়েছে জানিয়ে বলা হয়- বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের মধ্যে ধর্মীয় উস্কানি দেয়ার বিষয়টিও সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ১০ শতাংশ শিশু ধর্মীয় উস্কানিমূলক বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হওয়ার অভিযোগ করেছে। কিশোর বয়সীরা (১৬ থেকে ১৭ বছর) অন্য বয়সীদের তুলনায় এই ধরনের উস্কানিমূলক বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হচ্ছে বলে রিপোর্টে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে ইউনিসেফের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান এডয়ার্ড বেগবেদার বলেন, বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা আমরা শুনেছি। তারা যা বলছে, তাতে পরিষ্কার; ইন্টারনেট একটি নির্দয় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট দিবসে ইউনিসেফ তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনুসরণ করছে এবং অনলাইনে তাদের প্রতি সদয় হতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। সমীক্ষা মতে, প্রায় ২৫ শতাংশ শিশুর ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ ঘটে। শিশুদের একটি বড় অংশ (৬৩%) প্রাথমিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্থান হিসেবে তাদের নিজেদের কক্ষটিকেই ব্যবহার করে। এটা ‘বেডরুম কালচার’-এর ব্যাপকতা নির্দেশ করে, যা অপেক্ষাকৃত কম নজরদারির মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে।

বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় অনলাইনে প্রবেশাধিকারের সুযোগ ও ব্যবহারের দিক থেকে মেয়েরা ৪৮% ও ছেলেরা (৬৩%) এগিয়ে বলে জরিপে ধরা পড়েছে। জরিপ বলছে, শিশুরা ইন্টারনেটে নিয়মিত যে দুটি কাজ করে তা হলো- অনলাইন চ্যাটিং (বার্তা আদান-প্রদান) ও ভিডিও দেখা। প্রতিদিন গড়ে ৩৩ শতাংশ সময় অনলাইন চ্যাটিংয়ে এবং ৩০ শতাংশ সময় ভিডিও দেখায় তারা কাটায় বলেও জানানো হয়েছে। সমীক্ষায় যে বিপদটি চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো- ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের একটি অংশ তাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে সেই অনলাইন ‘বন্ধুদের’ সঙ্গে সরাসরি দেখা করার কথাও স্বীকার করে। ক্ষতিকর সামগ্রী, যৌন নিগ্রহ, অপব্যবহার এবং ভয়ভীতির সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি থেকে শিশুরা কখনোই মুক্ত নয় বলে মন্তব্য করে জাতিসংঘ বলছে, অনলাইনে হয়রানি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন ব্যাপক ক্ষতির বড় কারণ হতে পারে। অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় যারা অনলাইনে ভয়ভীতির শিকার হয়, তাদের এলকোহল ও মাদকে আসক্ত হওয়া এবং স্কুল ফাঁকি দেয়ার হার বেশি বলেও জানানো হয়। এ ছাড়া তাদের পরীক্ষায় ফল খারাপ করা, আত্মসম্মান কমে যাওয়া ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়ার আশঙ্কার কথাও জরিপ রিপোর্টে উঠে এসেছে।

মন্ত্রী জানালেন মার্চে চালু হচ্ছে কন্টেন্ট ফিল্টারিং, বন্ধ হবে পর্নো সাইট
ইউনিসেফের জরিপ এবং সুপারিশের প্রেক্ষিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, শিশুদের জন্য ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অ্যাপ চালু করাসহ নেতিবাচক কন্টেন্ট ফিল্টারিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফিল্টারিং প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসেই (মার্চে) এর ব্যবহার শুরু হবে।

এতে পর্নো সাইটসহ বিপদগামী অন্যান্য সাইট বা অ্যাপ বন্ধ করে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলেও আশা করেন তিনি। মন্ত্রী তার বক্তব্যে আগামী দিনে ফাইভ জি’র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার পাশাপাশি এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, বর্তমান মাধ্যমিক স্তরে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা চালু রয়েছে। শিশুদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রাথমিক স্তরে এটি প্রবর্তনের চিন্তা করছে সরকার। তথ্য বা ডেটা নিরাপদ রাখা বর্তমান ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এটি মোকাবিলার মধ্য দিয়েই আমাদেরকে ‘ডিজিটাল’ হতে হবে। মন্ত্রী বলেন, খারাপ বা নেতিবাচক কন্টেন্টগুলোর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ নয়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এটি সাইবার দুনিয়ায় আসে। প্রযুক্তির নেতিবাচক দিনগুলোকে প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে নেতিবাচক কন্টেন্ট ঠেকাতে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে। দেশীয় আইন পরিপন্থি অনেক বিষয়ের প্রতি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মান দেখাতে সম্মত হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ব্যবহারকারীর সংখ্যা দশ বছর আগেও ছিল মাত্র ৮ লাখ। বর্তমানে তা প্রায় ৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।

ইন্টারনেট থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখতে অভিভাবকদের সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে মন্ত্রী বলেন, অভিভাবকদেরকেও ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্যারেন্টাইল গাইড নামে ইন্টারনেটে একটা অপশন আছে যা প্রয়োগের মাধ্যমেও খারাপ কন্টেন্ট থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখা যায় বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=158218&cat=2