৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ১০:২২

সরকারের গচ্চা ২১০ কোটি টাকা

৩০০ কোটি টাকা মূল্যের জমির দাম দেখানো হয়েছে মাত্র ৯০ কোটি টাকা। এতে করে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে ২১০ কোটি টাকা। ১৪ লাখ বর্গফুট ফ্লোরে অংশীদারিত্ব চার লাখ ৩৯ হাজার ১১৩ বর্গফুট। সব মিলিয়ে ল্যান্ড ওনার (জমির মালিক) হিসেবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ পাবে ৩১% ও ডেভেলপার কোম্পানি পাবে ৬৯%। যদিও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ আবাসিক ফ্লোর স্পেস পাবে ৩৬% ও বাণিজ্যিক ফ্লোর স্পেস পাবে মাত্র ১০%। জমির মালিক হিসেবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কোনো সাইনিং মানিও পায়নি। ঢাকার মিরপুর ৯ নং সেকশনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) ফ্ল্যাট নির্মাণে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে ঠকিয়ে এভাবেই লুটপাটের আয়োজন করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

এরই মধ্যে কালো তালিকাভুক্ত ডেভেলপার কোম্পানি ‘ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেড’-এর সঙ্গে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পিপিপি চুক্তি দলিল অনুমোদনের পর স্বাক্ষরিত হয়েছে। সব কাজই হয়েছে ত্বরিত গতিতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল ইসলাম বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর জনতা হাউজিংয়ের সঙ্গেই ট্রপিক্যাল হোমসের তৈরিকৃত একটি ভবন রয়েছে। কয়েক বছর আগে শতাধিক ফ্ল্যাটের এ ভবনটি তারা নির্মাণ করে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জায়গায় ভবন নির্মাণের কারণে ‘ট্রপিক্যাল হোমস’-এর ভবনটির কোনো ছাড়পত্র দিচ্ছে না গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। ফলে তারা কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান।

এ কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকেই ফ্ল্যাট নির্মাণে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি দেয়া হয়েছে। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর ৯ নং সেকশনে ‘মিরপুর স্যাটেলাইট টাউন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জমির পরিমাণ ৫ একর বা ৩০০ কাঠা। ২০১১ সালে এ জমিতে ১৪ লাখ বর্গফুট স্থাপনা বানানোর প্রস্তাব করে ট্রপিক্যাল হোমস। এর মধ্যে আবাসিক ফ্লোর ১২ লাখ বর্গফুট ও বাণিজ্যিক ফ্লোর দুই লাখ বর্গফুট। আবাসিক ফ্লোরকে উচ্চ আয়ের, মধ্য আয়ের, নিম্ন আয়ের- এ তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে তারা। উচ্চ আয়ের লোকদের জন্য বানানো ফ্ল্যাটের কোনো স্পেস জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে দেবে না ট্রপিক্যাল হোমস। তারা দুই লাখ বাণিজ্যিক ফ্লোর স্পেসের মধ্যে ২০ হাজার বর্গফুট, মধ্যম আয়ের জন্য ৩০ হাজার বর্গফুট এবং নিম্ন আয়ের জন্য দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেস দেবে। সব মিলিয়ে চার লাখ ৩৯ হাজার ১১৩ বর্গফুট দেবে ডেভেলপার কোম্পানি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ভবনের মাঝামাঝি স্থানে তৈরিকৃত, কোনাকুনি এবং উঁচু তলার ফ্ল্যাটগুলো জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে দেবে ট্রপিক্যাল হোমস। ওই ভাবেই বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অলিখিত চুক্তি হয়েছে। এসব ভবনের পাশ দিয়ে তৈরিকৃত ১০০ ফুট রাস্তা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ নিজ খরচে করে দেবে। এ ছাড়া আগামীতে সার্ভিস চার্জ অনেক বেশি হবে- এজন্য আগামীতে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে কেনা ফ্ল্যাট মালিকরা বিপদে পড়তে পারেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ‘মিরপুর স্যাটেলাইট টাউন’ প্রকল্পটি নিয়ে নিজেদের উচ্চাভিলাষী লাভের কথা প্রকাশ করছে প্রতিষ্ঠানটি। অজানা কারণে ৩০০ কোটি টাকার জমির দাম মাত্র ৯০ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। যদিও এ প্রকল্পের আশেপাশে প্রতি কাঠা জমি এক কোটি টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। তবে ফ্ল্যাট বিক্রিতে উচ্চ দর দেখানো হয়েছে। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রাপ্য অংশের প্রস্তাবিত বিক্রয়মূল্য ২২৬ কোটি ৪১ লাখ ৮৫ হাজার নয়শ’ টাকা দেখিয়েছে।

এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গফুট ১১ হাজার টাকা, মধ্যম আয়ের জন্য আবাসিক ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গফুট ৫২০০ টাকা এবং নিম্ন আয়ের জন্য আবাসিক ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গফুট ৪৩০০ টাকা দেখানো হয়েছে। আদতে এ দামে ফ্ল্যাট বিক্রি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এদিকে ২০১৪ সালে মিরপুর ৯ নং সেকশনে ৫ একর বা ৩০০ কাঠা জমির উপর ‘মিরপুর স্যাটেলাইট টাউন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। প্রথম দুই বছর কাজ অনেকটা ঢিমেতালে চলে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) পদে এসএএম ফজলুল কবির যোগদানের পর প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি পায়। এরপর থেকে ফাইলটি চলছে অনেকটা ত্বরিত গতিতে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, যোগ্যতা ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত টেন্ডার কমিটি, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি এবং টেকনিক্যাল সাব কমিটি গঠনে তড়িঘড়ি করা হয়েছে। ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের যেকোনো নোট শিটে একই তারিখে সহকারী প্রকৌশলী থেকে চেয়ারম্যান পর্যন্ত সবাই স্বাক্ষর করেছেন।

২০১৬ সালের ১৭ই অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এক আদেশে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি পুনর্গঠন করে। এতে কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়)- নিজেই নিজের নাম প্রস্তাব করেন। টেন্ডার সংক্রান্ত এসব কমিটি গঠনে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামান ও চুক্তিতে নিয়োজিত সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) এসএএম ফজলুল কবির নিজেদের পছন্দকে প্রাধান্য দেন। ২০১৬ সালের ১৭ই নভেম্বর সহকারী প্রকৌশলী সালওয়া জামান তিন সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এতে কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ঢাকা ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান ঢাকা ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীকে বাদ দিয়ে পরিকল্পনা শাখার নির্বাহী প্রকৌশলীকে সদস্য সচিব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন।

টেকনিক্যাল সাব-কমিটি গঠনের প্রস্তাবে কাজ শেষ করার টাইম ফ্রেম বেঁধে দেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান। অজানা কারণে এরপর থেকে দ্রুততার সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিয়েছেন সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) এসএএম ফজলুল কবির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিপিপি’র নামে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া ঠিক হয়নি।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রপিক্যাল হোমসের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা আক্তার হোসাইন মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে আপনাকে অফিসে এসে যোগাযোগ করতে হবে। এভাবে মোবাইলে কোন তথ্য দেয়া যাবে না।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=158219&cat=2