৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ১০:১৩

আঞ্চলিক সঙ্কটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

কানাডীয় হাইকমিশনের আলোচনা

রোহিঙ্গাবিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত বব রে বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যু একটি আঞ্চলিক সঙ্কটে রূপ নিতে চলেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রভাব এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়বে। নিরাপত্তা ও কৌশলগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আজ হোক, কাল হোক তাদের সেখানেই ফিরে যেতে হবে। তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে মঙ্গলবার আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বব রে এসব কথা বলেন। রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের সহায়তায় কানাডা হাইকমিশন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ইনস্টিটিউট ফর পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (আইপিএজি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মুনীর খসরু। বক্তব্য রাখেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজ (বিপস) প্রধান মেজর জেনারেল (অব:) এ এন এম মুনিরুজ্জামান ও চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়।

মূল বক্তা বব রে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিচিত্র দিক রয়েছে। এটি একই সাথে জটিল ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফল। কর্তৃত্ববাদী শাসন, ধর্মীয় নিধন এবং প্রাকৃতিক সম্পদÑ এই সঙ্কটের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদের জন্য দেশটির ক্ষমতার প্রধান অংশীদার সেনাবাহিনী এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থগোষ্ঠীর বহুমুখী প্রতিযোগিতা এই সঙ্কটকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

বর্তমান ভূ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সুবিধাজনক অবস্থানে আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করছে। এটি তাদের রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দিচ্ছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারছে না। মিয়ানমার সরকারের সাথে ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এই সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি সুরাহার পথ খোঁজা প্রয়োজন। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বললে বাংলাদেশের জন্য তা অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই এই সঙ্কট সমাধানের জন্য স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সমাধানের পথও খুঁজতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। একই সাথে শরণার্থীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা কট্টরপন্থা কিংবা সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে না পড়ে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য পাঁচ-দশ বছর লেগে যেতে পারে। এই আঞ্চলিক সঙ্কট নিরসনে একমাত্র চীনই আমাদের সহায়তা করতে পারে। এ ইস্যুতে চীনের কাছ থেকে সরাসরি কূটনৈতিক সহায়তা পাওয়া সম্ভব না হলে জাপান বা আসিয়ানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।

মেজর জেনারেল (অব:) মুনিরুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর এক বছর পার হয়েছে, কিন্তু সমাধানের পথে আমরা বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা আমাদের জন্য নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করছে। বিশেষত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুই দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে সংলাপ বা আলোচনা কার্যকর ফল দিতে পারে।

সুরাহা রাজনৈতিকভাবে হতে হবে : রোহিঙ্গা সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) বাংলাদেশ প্রধান ইখতিয়ার আসলানোভ বলেছেন, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে কেবল ঘরবাড়ি বানানোই যথেষ্ট নয়। প্রতিবেশীরা বিপজ্জনক থাকলে রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরে যেতে উৎসাহী হবে না। রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা ও জীবিকার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনকভাবে এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে খুব সামান্য।

বনানীর আইসিআরসি কার্যালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। ইখতিয়ার আসলানোভ জানান, যেকোনো ঘটনায় শরণার্থীদের দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার গতি অনেক বেশি থাকে। আর প্রত্যাবাসন হয় ধীরে। প্রত্যাবাসন শরণার্থী সঙ্কট সুরাহার একটি উপায় ঠিকই, তবে তার জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিবেশ। রাখাইনের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল নয়। এ ব্যাপারে আইসিআরসির উদ্বেগ রয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মনে ভয়াবহ নৃশংসতার তাজা স্মৃতি রয়েছে। রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি বৌদ্ধদের বিরূপ মনোভাব এখনো রয়েছে। সম্পদের জোগান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করার মাধ্যমে এ রাজ্যের উন্নয়ন দরকার। কফি আনান কমিশন এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে, যার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অনুকূল পরিবেশের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই গত নভেম্বরে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।

আসলানোভ বলেন, ২০১২ সাল থেকে রাখাইনে সক্রিয় রয়েছে আইসিআরসি। বর্তমানে রাজ্যের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া এবং জীবিকার সুযোগ সৃষ্টিতে সংস্থাটি কাজ করছে। সঙ্কট সুরাহার জন্য চলমান সংলাপ আশাব্যঞ্জক, তবে তা আরো প্রকাশ্যে হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সুরাহায় মিয়ানমারকে সক্রিয় করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অব্যাহত চাপ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মানবিক বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে সরিয়ে নিতে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে আইসিআরসির ডেলিগেশন প্রধান বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা বা অন্য কোনো বিবেচনায় শরণার্থীদের সরিয়ে নেয়ার আইনগত অধিকার সরকারের রয়েছে। তবে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া অনেক সময়ই নতুন জটিলতার জন্ম দেয়। রোহিঙ্গারা একবার রাখাইন থেকে কক্সবাজার এসে থিতু হয়েছে। এখন তাদের একটি অংশকে আবার ভাসানচরে নেয়া হবে। অবশ্য এক জায়গায় অনেক শরণার্থী একসাথে গাদাগাদি করে বাস করলেও সমস্যা দেখা দেয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে আসলানোভ বলেন, বাংলাদেশের কারগারগুলো পরিদর্শনের একটি সীমিত ম্যান্ডেট আইসিআরসির রয়েছে, তবে তা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে দেয়ার বিধান নেই। তা সুপারিশসহ কারা মহাপরিদর্শককে দেয়া হয়। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, কারগারগুলোতে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি বন্দী ও কয়েদি রয়েছে। কারাগারে আটকদের ৮১ ভাগই বিচারাধীন মামলার আসামি। তাই অবকাঠামো সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুততর করার মাধ্যমে এ পরিস্থিতি সহনীয় মাত্রায় আনা যায়।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/386267