৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ১০:০৮

স্বদেশ ভাবনা

প্রত্যাখ্যান না করে সুপারিশগুলো আমলে নেয়া হোক

আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস (মাইডাস) সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।


টিআইবির পর্যালোচনাভুক্ত ৫০টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনে যে অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। টিআইবি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘আংশিক অংশগ্রহণমূলক’ বলে অভিহিত করেছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ’ হয়েছে বলেও সংস্থাটি মন্তব্য করেছে। গবেষণাধর্মী এ প্রতিবেদনে কয়েকটি দিকনির্দেশনামূলক সুপারিশও করেছে টিআইবি। ইতিপূর্বে সময়ে সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা সরকার যেভাবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ও টিআইবি রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে, বর্তমান সরকারও তা-ই করেছে।

টিআইবির পর্যালোচনাভুক্ত ৫০টি সংসদীয় আসনে সংস্থাটির গবেষক দল যা দেখেছে তা প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলো হল- এক. পঞ্চাশটি সংসদীয় আসনেই নির্বাচনের জন্য যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রয়োজন, তা ‘অনুপস্থিত ছিল’ এবং একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় তৎপর ছিল। কোনো কোনো আসনে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে। দুই. তফসিল ঘোষণার পর ওই আসনগুলোয় ১২ হাজার ৬৮৯ জন সরকারবিরোধী জোটের প্রার্থী ও নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এসব মামলায় গ্রেফতার হন ৩ হাজার ৭৩৩ জন। তিন. নির্বাচনের দিন উল্লিখিত ৫০টি আসনের ৪৭টিতেই কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পায় টিআইবির গবেষক দল। এসব অনিয়মের ধরনের মধ্যে ছিল নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সিল মেরে রাখা, ভোটের দিন আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া এবং বুথ দখল করে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালটে সিল মারা, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া এবং সরকারবিরোধী জোটের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া। চার. সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করা ও পুড়িয়ে দেয়া। পাঁচ. পর্যালোচনাভুক্ত পঞ্চাশ আসনের ৪১টিতে জালভোট দেয়া এবং ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা পালন করা।

প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, টিআইবি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে আংশিক অংশগ্রহণমূলক বলছে তার কারণ নির্বাচনে সব দলের প্রার্থী থাকলেও সবার সমান সুযোগ ছিল না। তিনি আরও বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখা যায়নি।

প্রতিপক্ষকে দমনে সরকারি দলের সহায়ক অবস্থান নিতে দেখা গেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে দেখা গেছে। তাছাড়া নির্বাচনের সময় তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের জন্য অভূতপূর্ব কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে দেখা গেছে, যা আইনের লঙ্ঘন।

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে ৬টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলো হল- ১. সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই মর্মে আইন প্রণয়ন করতে হবে। ২. একটি দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হতে হবে।

৩. একাদশ সংসদ নির্বাচনে বর্ণিত অনিয়মগুলো সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে এবং তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা প্রতিপালনে ব্যর্থতার কারণ নির্বাচন কমিশনকে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করবে।

৫. নির্বাচনে ডিজিটাল পদ্ধতি পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ৬. নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা যাতে মুক্তভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারের একাধিক মন্ত্রী টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, টিআইবি অলীক গল্প সাজাচ্ছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন ত্রুটিপূর্ণ, একপেশে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

এ দেশে সরকারের টিআই বা টিআইবি রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করা এবং বিরোধী দলের সেটিকে স্বাগত জানানো নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলের শেষ বছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়। আওয়ামী লীগ এর প্রতিবাদ করে।

অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি টিআই’র মূল্যায়নকে সঠিক বলে অভিহিত করে। আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে এ অপবাদকে বিএনপি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগের শাসনের ২০০১ সালের ধারাবাহিকতায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ যখন পরপর চারবার দুর্নীতিতে প্রথম হয়, তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার টিআইয়ের জরিপ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং টিআইকে ভুল তথ্য সরবরাহের জন্য টিআইবিকে দায়ী করে।

আর বিরোধী দল আওয়ামী লীগ টিআই’র মূল্যায়নকে সঠিক বলে অভিহিত করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এই কলঙ্ক ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। ২০১৪ সালের অক্টোবরে টিআইবি ‘নবম জাতীয় সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এতে দেখানো হয়, সংসদ সদস্যদের ৯৭ শতাংশ বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যক্রমে যথা- স্থানীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন বরাদ্দ নিজের কাজে ব্যবহার, স্থানীয় কর্মকাণ্ডে দলের নেতাদের প্রাধান্য প্রদান ইত্যাদিতে জড়িত।

নেতিবাচক কাজে জড়িত সংসদ সদস্যদের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, টিআইবির এ রিপোর্ট ঠিক নয়, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, টিআইবির এ রিপোর্ট সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য।

কারণ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের কথা প্রশাসন শোনে না। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিআইবি পরিচালিত মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক জাতীয় খানা জরিপ ২০১২ প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, দেশের ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টিআইবির তীব্র সমালোচনা করে এবং জরিপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

২০১৪ সালের মার্চে টিআইবি নবম জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের ওপর পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টিআইবির সমালোচনায় মুখরিত হয় এবং সার্ভে পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি নবম জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের ওপর পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদনকে সমর্থন জানায়। সম্প্রতি টিআই প্রকাশিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৮’তে ৬ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

অর্থাৎ এবার স্কোর অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো থেকে খারাপের দিকে- ১৪৯তম। গতবার ছিল ১৪৩তম। সরকার টিআই’র এ প্রতিবেদনকে ত্রুটিপূর্ণ, অস্বচ্ছ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছে। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেছেন, রিপোর্টের বক্তব্য ঠিক নয়। তিনি গণমাধ্যম থেকে যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে কোথাও এ নির্বাচন নিয়ে কোনোরকমের অভিযোগ আসেনি বলে জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে যা উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল, শুধু টিআইবি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত বলে আখ্যায়িত করেনি, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।

বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাযথ হয়নি বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। এ অবস্থায় একটি ইতিবাচক ফলের জন্য রাজনৈতিক সব পক্ষকে নিয়ে অর্থপূর্ণ সংলাপের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।

এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন দাবি করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়ে যায় না। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে। সবার কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরীক্ষিত হবে।

সবশেষে বলতে চাই, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে টিআইবি প্রণীত ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদন’ প্রত্যাখ্যান না করে এর সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া।

বৈশ্বিক ‘গণতন্ত্র সূচক ২০১৮’-এ ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ কিংবা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা মিশ্র শাসন তালিকায় দেশটির অবস্থান। এক সময়ের গণতান্ত্রিক দেশটির এ অবস্থান অবমাননাকর। এ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতেই হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই পরিত্রাণের প্রধান উপায়।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/141424/