৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:২৩

সুপারিশ ছাড়া কোনো ক্ষমতা নেই নদী কমিশনের

দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাভূমি, হাওর ও সমুদ্র উপকূল দূষণ ও দখলমুক্ত রাখতে সরকারকে সুপারিশ করা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা নেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের। নির্বাহী কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কমিশনের কার্যপরিধিতে। কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও নেই তাদের।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আইনে রয়েছে নানা দুর্বলতা, আছে সরকারের অন্যান্য বিভাগের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা। ছয় বছর পরও নেই নিজস্ব অফিস। রয়েছে জনবল সংকট। বরাদ্দও কম বাজেটে। দেশের অন্য কমিশনগুলো আইনিভাবে শক্তিশালী করে গঠন করা হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কমিশনের সদস্যরাই বলছেন, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো অবস্থা এ কমিশনের। অনেকে আবার কাগুজে বাঘ বলেও উপহাস করেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে কেবল সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

দেশের নদী রক্ষায় অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৪ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।

কিন্তু জনবল সংকটে ভুগছে এখন এটা। নদী কমিশনের পাঁচ সদস্য (একজন চেয়ারম্যান)। এর মধ্যে একজন সার্বক্ষণিক সদস্য আর তিন সদস্য অবৈতনিক হিসেবে আছেন। দুই-তিন মাস পর পর সদস্য মিটিং হলে কমিশনে আসেন তারা। কর্মকর্তা আছেন মাত্র আটজন। কমিশন চলছে এভাবেই।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনে নদীর স্বার্থে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়, অবৈধ দখল ও পুনর্দখল রোধ, নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখা, বিলুপ্ত ও মৃতপ্রায় নদী খনন, নদী রক্ষায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, নিয়মিত পরিদর্শন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিশনকে। নদী কমিশনের কাজ হচ্ছে সরেজমিন নদীর পরিস্থিতি দেখবে, এরপর তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি কর্মকর্তা এবং সংশ্নিষ্ট এলাকার জেলা প্রশাসকদের অবহিত করবে। তবে স্থানীয় প্রশাসন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ নদী দখল ও দূষণের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা যুক্ত থাকে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, 'কোথায় কারা নদী দখল ও দূষণ করছে নদী কমিশন তা চিহ্নিত করে দিলে সরকার সাংবিধানিকভাবে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হলে তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব দিতে পারে। ভূমি কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকদের তো আইনি ক্ষমতা দেওয়া আছে। কমিশনের চেয়ারম্যান একসময় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন, তাই তার তো সবকিছু জানা আছে।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, 'নদী রক্ষা কমিশন একটি কাগুজে বাঘ। নদী কমিশনকে ইচ্ছা করেই দুর্বল করে রাখা হয়েছে। এটি শক্তিশালী করতে হলে ঢেলে সাজাতে হবে। সদস্য বাড়াতে হবে। কমিশনের দায়িত্ব দিতে হবে জাতীয় পর্যায়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা নদী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এমন ব্যক্তিকে। নদী বাঁচাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুল নীতিমালার সংশোধন করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানের ভুলে দেশের শত শত নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ইতোমধ্যে বহু নদীর মৃত্যু হয়েছে।'

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, 'আমরা ইতোমধ্যে ৫৮ জেলা পরিদর্শন করেছি। স্থানীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে নদী দখল ও দূষণ চিহ্নিত করেছি। কারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কমিশন শিগগিরই দেশের ৬৪ জেলার সব নদ-নদী দখল-দূষণ বিষয়ে একটি মানচিত্র ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।' তিনি বলেন, 'দেশের এমন কোনো নদী নেই যে, দখল বা দূষণ হয়নি। কমিশনের আইনি সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ ও নদী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মমতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নদী দখলের বিরুদ্ধে অসম্ভবকে সম্ভব করে এগিয়ে যাচ্ছি। কমিশন ইতোমধ্যে দখলদারদের বড় একটি ধাক্কা দিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে। ক্ষমতাসীন কেউ যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে আইনিভাবে। নদী সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কমিশনের কাছে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষমতা থাকতে হবে। কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে মন্ত্রণালয় থেকে সব অধিদপ্তরকে। নদী কমিশনের বিভাগীয় অফিস বাড়াতে জনবল নিয়োগ দিতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, আইনিভাবে নদীর একমাত্র অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে কমিশনকে। প্রায়োগিক ক্ষমতা ও নদীর সীমানা নির্ধারণে কমিশনের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নেওয়ার আইনি বিধান রাখতে হবে। উচ্ছেদ অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হবে।'

নদীবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সারাদেশে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কমিশন উন্নয়নের পক্ষে, তবে নদী দখল করে ইকোনমিক জোন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র করার বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। নদীর ভূমি দখল করে কোনো গুচ্ছগ্রাম বা আদর্শ গ্রাম হতে পারে না। শহরকেন্দ্রিক নদী দখল করছে প্রভাবশালীরা। তাদের তালিকা আমরা চূড়ান্ত করেছি। বুড়িগঙ্গার ৩৩টি ডকইয়ার্ড সরানোর সুপারিশ করেছি।'

কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, নদী হচ্ছে দেশের অর্থনীতির প্রাণ ও জীববৈচিত্র্যের আধার। কমিশনের আইন সংশোধন করে ক্ষমতা বাড়াতে হবে, নদীর সীমানা নির্ধারণের পিলার বসানোর দায়িত্ব দিতে হবে। নদী দখল ও দূষণমুক্ত করা একটি বড় কর্মযজ্ঞ। কমিশন দেশের রাঘববোয়ালদের চিহ্নিত করেছে। এ জন্য কমিশনের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/1902251